পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in অতসী মামি ARV) কেশব যোলো-সতেরো বয়সের দুরন্ত শয়তান ছেলে। স্কুলে যায় না, লেখাপড়া করে না, একটু একটু শ্ৰীমস্তের মুহুবিব কাজ শেখে, ফাই-ফরমাশ খাটে, খায় আর ঘুরিয়া বেড়ায়। মাঝে মাঝে কুন্দ ও পশুপতির কাছে পয়সা আদায় করে। যত সে শয়তান ছেলে হােক, প্ৰাণ যে তার প্রচুর তাঁহাতে সন্দেহ নাই। সে গাছে ওঠে, কাঠ নির্যাতন করার সুযোগ খোঁজে। তাহার এই অধীব চঞ্চল প্ৰাণাবেগের কাছেই পশুপতি বোধ হয় আত্মবিক্ৰয় করিয়াছে ছেলেটাকে সে ভালোবাসে, ভযা করে, পূজা করে এবং ঘূণা করে। সামনে সজনে গাছের ডালে কবে এক অজানা তাহা নিজের চোখে দেখা চাই। সজনে গাছের ডাল ভারী বিশ্বাসঘাতক। কত মোটা ডাল কত সহজে ভাঙিয়া যায-ভিতরে শাঁস নাই। কেশব টিপ করিয়া খড়িয়াছিল পশুপতির সামনে। সে আতঙ্ক উত্তেজনা পশুপতি বাকি জীবনে ভুলিবে না। আর গাছ হইতে পড়িয়া কেশবকে সঙ্গে সঙ্গে খোড়াইতে খোড়াইতে পালাইয়া যাইতে দেখিবাব বিস্ময়। কেশব ঘরে ঢোকে উঠান হইতে একলাফে দাওয়া ডিঙাইয়া এবং এক এক সময় অকারণে ঘর হইতে বাহির হইয়া দাওয়ায় একটা বাঁশের খুঁটি ধরিয়া বো করিয়া এক পাক ঘূরিখা যায়। এবং তারপব আরও অকারণে ওই উঠানের প্রান্তে শ্ৰীমন্তের উদাসীন ছেলেমেয়ে বউদের দিকে আডচোখে চাহিতে থাকে। কিন্তু তাহার বাহাদুরিটা সম্যক বুঝিতে পারে শুধু পশুপতি। হ্রদায়ের যতটুকু উষ্ণতা তার আজও জীবনেব কামনা করে তাই দিয়া কেশবকে সে বোধ হয় হিংসা করে, তাই ভালোও বাসে। শিহরন আজ পশুপতিব দুর্লভ নয়। কিন্তু ছেলেটার কাণ্ডে তার যে শিহরন জাগে তাহা অভিনব, তাহা মৌলিক। তার ভীরু দুর্বল বুক আতঙ্কে টিপঢিপ করে, ব্যাকুল হইয়া কেশবকে মুখে এ সব কাণ্ড করিতে বারণ করে, কিন্তু দুচোখ প্ৰাণপণে কুঁচকাইযা এই চিত্তাকর্ষক অভিনয় দেখিতেও ছাডে না। শেষে বলে, শোন কাছে আয় দিনি! আয় না। দাদা, আয় ; ওরে আয় না! কেশবকে কাছে আনিয়া সে করিবে কী ? কিছু না। শুধু বসাইয়া রাখিবে। নিজে তো দিবারাত্রি বসিয়াই আছে, এই উত্তাল প্রাণশক্তিকেও সে একটু কাছে বসাইয়া রাখিবে। হয়তো প্ৰাণপণে দেখিবে ও দুই হাতে স্পর্শ কবিবে। কিন্তু সেটা বাহুল্য। জীবনের এই অসংযমকে নিজের কাছে সংযত করিয়া রাখাই তাহার আসল কামনা। একদিন এমনি দুবন্তপনার মধ্যে অত বড়ো ছেলে পশুপতির গায়ের উপর পড়িয়া গেল। তেমনভাবে পড়িলে পশুপতি বাচিত কিনা সন্দেহ, মাটিতে প্ৰথমে একটা হাত ফেলিয়া কেশব নিজেকে খানিকটা সামলাইয়া লইয়াছিল। তবু তার হাঁটুর আঘাতে পশুপতির বাঁকা কোমর যেন ভাঙিয়া গেল। দুদিন তার উঠিবার সামর্থ্য রহিল না। কেশব প্রায়ই নানা কারণে শাস্তি পায়। সেদিন তার শান্তিটা হইল ভীষণ।। শ্ৰীমস্তের হাতের শেষ থাপড়টাতে সে ঘুবিয়া পড়িয়া গেল। এবং শুধু কেশবের উপর দিয়া নয়, কুন্দকেও অনেক কথার মার সহা করিতে হইল। ছেলেকে যদি সে শাসন না করে এ বাড়িতে। তবে তার স্থান হইবে না, এমন আশঙ্কাজনক কথাটাও যেন শোনা গেল। কোমরের ব্যথায় সর্বাঙ্গ আড়ষ্ট হইয়া আসিলেও ওর মধ্যেই পশুপতির কী রকম একটা ব্যথিত আনন্দ হইয়াছিল। বাড়িতে যে হইচই বাধিয়াছিল, দু-তিনজনে তাহাকে যে পাখা করিয়াছিল, কেশব যে চেচাইয়া কঁাদিয়াছিল, এ সব দিয়া যেন এই সত্যটাই যাচাই হইয়া গিয়াছে যে জগতে আজও তার