পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in S8 মানিক রচনাসমগ্র দেবে না ? কমল প্রেস কত বড়ো প্রেস জানো! এবার ছেলে তাহার বাঁচিবে শ্যামা যে এ আশা করে না এমন নয়। মানুষের আশা এমন ভঙ্গুর নয় যে একবার ঘা খাইলে চিরদিনের জন্য ভাঙিয়া পড়িবে। তবু আশাতেই আশঙ্কা বাড়ে। সব শিশুই যদি মরিযা যাইত পৃথিবীতে এতদিনে তবে আর মানুষ থাকিত না, শ্যামার এই পুরানো যুক্তিটাও এবার হইয়া গিয়াছে বাতিল। সংসারে এমন কত নারী আছে যাদের সন্তান বঁাচে না। সেও যে তাদের মতো নয় কে তাহা বলিতে পারে? একে একে পৃথিবীতে আসিয়া তাহার ছেলেমেয়েরা কেউ বারোদিন কেউ ছ। মাস বঁাচিয়া যদি মরিয়া যাইতে থাকে? বলা তো যায় না। এমনই যাদের অদৃষ্ট তাদের এক একটি সন্তান দশ-বারো বছর টিকিয়া থাকিয়া হঠাৎ একদিন মরিষা যায়, এবকমও অনেক দেখা গিয়াছে। হালদার বাড়ির বড়ো বউ দুবার মৃতসন্তান প্রসব করিয়াছিল, তাবপরের সন্তান দুটি বাঁচিয়া ছিল বছরখানেক। শেষে যে মেয়েটা আসিয়াছিল তাহার বিবাহের বয়স হইয়াছিল। কী আদরেই মেযেটা বড়ো হইয়াছিল। তবু তো বাঁচিল না। নৈসর্গিক প্রতিবিধানের ব্যবস্থা এবার কম করা হয় নাই। শ্যামা গোটা পাঁচেক মাদুলি ধারণ করিয়াছে, কালীঘাট ও তারকেশ্বরে মানত করিয়াছে পূজা। মাদুলিগুলির মধ্যে তিনটি বড়ো দুর্লভ মাদুলি। সংগ্ৰহ করিতে শ্যামাকে কম বেগ পাইতে হয় নাই। মাদুলি তিনটির একটিতে প্রসাদি ফুল, একটিতে সন্ন্যাসীপ্রদত্ত ভস্ম ও অপরটিতে স্বপ্নাদ্য শিকড় আছে। শ্যামাব নির্ভর এই তিনটি মাদুলিতেই বেশি। নিজে সে প্রত্যেক দিন মাদুলি-ধোয়া জল খায়, একটি একটি কবিয়া মাদুলিগুলি ছেলের কপালে ছোযায়। তারপর খানিকক্ষণ সে সত্যসত্যই নিশ্চিন্ত হইয়া থাকে। এবারও মন্দাকিনী আসিযাছে। সঙেগ আনিয়াছে তিনটি ছেলেকেই। শ্যামার সেবা কবিতে আসিয়া নিজের ছেলের সেবা করিয়াই তাহার দিন কাটে। এমন আবদারে ছেলে শ্যামা আর দ্যাখে নাই। ঠাকুরমাব জন্য কঁদিতে কঁাদিতে যমজ ছেলে দুটি বাড়ি ঢুকি যাছিল, তারপর কতদিন কাটিয়া গিয়াছে, এখনও তাহারা এখানে নিজেদের খাপ খাওয়াইয়া লইতে, পারে নাই। বায়না ধরিয়া সঙ্গে সঙেগ না মিটিলে ঠাকুরমার জন্যই তাহদের শোক উথলিয়া ওঠে। দিবারাত্রি বায়নারাও তাঁহাদের শেষ নাই। অপরিচিত আবেষ্টনীতে কিছুই বোধ হয় তাহদের ভালো লাগে না, সর্বদা খুঁতখুঁত করে। কাবণে অকাবণে রাগিয়া কঁদিয়া সকলকে মারিয়া অনৰ্থ বাধাইয়া দেয়। মন্দা প্ৰাণপণে তাহাদেব তোয়াজ করিয়া চলে। সে যেন দাসী, রাজার ছেলে দুটি দুদিনের জন্য তাহার অতিথি হইয়া সৌভাগ্য ও সম্মানে তাহাকে পাগল করিয়া দিয়াছে, ওদের তুষ্টির জন্য প্ৰাণ না দিয়া সে ক্ষান্ত হইতে পারে না। শ্যামা প্রথমে বুঝিতে পারে নাই, পরে টের পাইয়াছে এমনিভাবে মাতিয়া থাকিবার জন্যই মন্দা এবার ছেলে দুটিকে সঙেগ আনিয়াছে। সেখানে শাশুডিকে অতিক্ৰম করিয়া ওদের সে নাগাল পায় না। সাধ মিটাইয়া ওদের ভালোবাসিবাব জন্য, আদবযাত্ন করিবার জন্য, সেই যে ওদের আসল মা এটুকু ওদের বুঝাইয়া দিবার জন্য, মন্দা এবার ওদের সঙ্গে আনিয়াছে। আনিয়াছে চুরি করিয়া। মন্দাই সবিস্তারে শ্যামাকে ব্যাপারটা বলিয়াছে। কথা ছিল শুধু কোলের ছেলেটিকে সঙ্গে লইয়া মন্দা আসিবে, শাশুড়ির দুচােখেব দুটি মণি যমজ ছেলে দুটি, কানু আর কালু, শাশুড়ির কাছেই থাকিবে। কিন্তু এদিকে কাদাকাটা করিয়া স্বামীর সঙ্গে যে গভীর ও গোপন পরামর্শ মন্দা করিয়া রাখিয়াছে শাশুড়ি তার কী জানেন? মন্দাকে আনিতে গিয়াছিল শীতল, কানু ও কালু স্টেশনে আসিয়াছিল বেড়াইতে, রাখাল সঙ্গে আসিয়াছিল তাঁহাদের ফিরাইয়া লইয়া যাইবার জন্য। গাড়ি ছাড়িবার সময় রাখাল একই নামিয়া গিয়াছিল। কানু ও কালু তখন নিশ্চিন্ত মনে রসগোল্লা খাইতেছে। শীতল বলিয়াছিল, গাড়ি ছাড়ার সময় হল, ওদের নামিয়ে নাও হে রাখাল।