পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in აvტ\ე মানিক রচনাসমগ্র বাড়ির দরজা থেকে কাছে এসে দাঁড়ানো পর্যন্ত আনন্দ হেরম্বকে নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে দেখেছিল। সে এসে দাঁড়ানো মাত্র হেরম্ব তার চােখের দিকে তাকাল। কৌতুহল অন্তহিত হযে আনন্দের চোখে তখন ঘনিয়ে এল ভাব ও ভয়। হেরম্ব এটা লক্ষ করেছে। সে জানে এই ভয় ভীরুতার লক্ষণ নয়, মোহের পরিচয। আনন্দের চোখে যে প্রশ্ন ছিল, হেরম্বের নির্বক নিস্ক্রিয় জবাবটা তাকে মুগ্ধ করে দিয়েছে। সুপ্রিয়াকে ত্যাগ করে এসে হেরম্বের যা হয়নি, এখন তাই হল। নিজের কাছে নিজের মূল্য তার অসম্ভব বেড়ে গেল। সে জটিল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সাধারণ সুস্থ মানুষ সে নয়। মন তার সর্বদা অপরাধী, অহরহ তাকে আত্মসমর্থন করে চলতে হয়। জীবনে সে এত বেশি পাক খেয়েছে যে মাথা তার সর্বদাই ঘোবো। আনন্দ, পুলক ও উল্লাস সংগ্ৰহ করা আজ তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু আনন্দ আজ তাকে আর তার দৃষ্টিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে, বিচলিত হয়ে তাকে ছেলেমানুষের মতো উল্লসিত৷ করে দিয়েছে। তাব দেহ,মন হঠাৎ হালকা হয়ে গিয়েছে। তার মনে ভাষার মতো স্পষ্ট হযে এই প্রার্থনা জেগে উঠেছে, আনন্দ যেন চলে যাবার আগে আর একবার তার চোখেব দিকে এমনি ভাবে তাকিযে ডাকলে কেন মা ? আনন্দ মৃদুস্বাবে জিজ্ঞাসা করল। একে এক গেলাস জল এনে দে । আনন্দ জল আনতে চলে গেলে হেব্বস্ব যেন অসুস্থ হয়ে ঝিমিয়ে পড়ল। অনেকদিন আগে অস্ত্ৰোপচারের জন্য তাকে একবার ক্লোরোফর্ম করা হয়েছিল। সেই সময়কার অবর্ণনীয অনুভূতি যেন ফিরে এসেছে। মালতী নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, কী বকম দেখলে আমার আনন্দকে ? বেশ, মালতী বউদি। আঠারো বছর আগে ওকে কোলে পেয়েছিলাম হেরম্ব। জীবনে আমার দুটি সুদিন এসেছে। প্রথম, তোমার মাস্টারমশায় যেদিন দাদাকে পড়াতে এলেন, অন্দরের জানালায় অন্ধকারে ঠান্য দাঁড়িয়ে আমি লোকটাকে দেখলাম, সেদিন। আর যেদিন আনন্দ কোলে এল। প্রসববেদনা কেমন জান ? হেরম্ব জোর দিযে বলল, জানি। জানো! পাগল নাকি, তুমি কী করে জানবে। আমি এককালে কবিতা লিখতাম যে মালতী বউদি। কবিতা লেখা আর প্রসববেদনা কী এক ? মাথা খারাপ না হলে কেউ এমন কথা বলে! তোমাতে আর ভগবান লক্ষ্মীছাড়াতে তাহলে আর কোনো প্ৰভেদ থাকত না বাপ। আমরা প্রসব করি ভগবানের কবিতাকে, তার তুলনায় তোমাদের কবিতা ইয়ার্কি ছাড়া আর কি! যাই হােক, আনন্দকে দেখে আমি সেদিন প্রসববেদনা ভুলে গেলাম হেরম্ব। সব মা-ই তাই যায়, মালতী বউদি। . মালতী রাগ করে বলল, তুমি বড়ো বৃঢ় কথা বলে হেরম্ব! আনন্দ জল আনলে গেলাস হাতে নিয়ে হেরম্ব বলল, বোসো আনন্দ । আনন্দ অনুমতির জন্য মালতীর মুখের দিকে তাকাল। মালতী বলল, বোস লো স্টুড়ি, বোস। এ ঘরের লোক। কেমন ঘরের লোক জানিস? আমার ছেলেবেলার ভালোবাসার লোক। ওরা যখন বারো বছর বয়স আমাকে বিয়ে করার জন্য খেপে উঠেছিল। রোজ সন্দেশ-টন্দেশ খাইয়ে কত কষ্টে যে ভুলিয়ে রাখতাম, সে কেবল আমিই জানি।