পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in Sao মানিক রচনাসমগ্ৰ এই ব্যাখ্যা অথবা কৈফিয়ত হেরম্বের মনে লাগল। সে বুঝতে পারল তার মতামতকে অগ্রাহা করে বলে নয়, শেষপর্যন্ত তার কাছে কোনো কথাই লুকানো থাকবে না বলেই মালতী কোনো বিষয়ে লুকোচুরির আশ্রয় গ্ৰহণ করছে না। নিজের এবং নিজেদের সঠিক পরিচয় আগেই তাকে জানিয়ে রাখছে। এর মধ্যে আরও একটা বড়ো কথা ছিল, হেরম্বকে যা পুলকিত করে দিল। মালতী আশা করে আজই শেষ নয়, সে আসা-যাওয়া বজায় রাখবে। ভূমিকাতেই তার সামনে নিজের সব দুর্বলতা ধরে দিয়ে মালতী শুধু এই সম্ভাবনাই রহিত করে দিচ্ছে যে ভবিষ্যতে তার যেন আবিষ্কার করার কিছু না থাকে। হেরন্মের মনে হল এ যেন একটা আশ্বাস, একটা কাম্য ভবিষ্যৎ । সে বারবার আসবে এবং তাদের সঙ্গে এতদূর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবে যে মালতীর খাপছাড়া জীবনের সমস্ত দীনতা ও অসঙ্গতি, সে জেনে ফেলবে, মালতীর এই প্রত্যাশা নানা সম্ভাবনায় হেরান্সের কাছে বিচিত্র ও মনোহর হয়ে উঠল। মালতীর এই মৌলিক আমন্ত্রণে তার হূদয় কৃতজ্ঞ ও প্রফুল্ল হয়ে রইল। এ কথা মিথ্যা নয় মালতী বউদি। আমার কাছে কিছুই গোপন করবার দরকাব নেই। গোপন করার কিছু নেই-ও হেরম্ব। কী থাকবে ? তাই বলছি। কিছুই নেই। একটা যেন চুক্তি হয়ে গেল। মালতী স্বীকার কবল সে কারণ পান করে, লোকঠকানো পযসায্য জীবিকা নির্বাহ করে। হেরম্ব ঘোষণা করল, তাতে কিছু এসে যায় না। জীবন মালতীকে অনেক শিক্ষা দিয়েছে, হয়তো সে শিক্ষা কুন্দয়সংক্ৰান্ত নয়। কিন্তু তার তীক্ষ্ম বুদ্ধিতে সন্দেহ কবা চলে না। কিন্তু আনন্দ ? আনন্দের হৃদয় কি প্রযোজনীয় শিক্ষা ও মার্জনা পায়নি? ওর জমকালো বাইরেব বুপ তো ওব বৃদয়কে ছাপিযে নেই?—হেরম্ব এই কথা ভাবে।-মালতী যে মেয়েকে কুশিক্ষা দেবে তার এ আশঙ্কা কমে এসেছিল। সে ভেবে দেখেছে, মালতী ও আনন্দের জীবন এক নয়। যে সব কাবণ মালতীকে ভেঙেছে, আনন্দের জীবনে তার অস্তিত্ব হয়তো নেই। তাছাড়া ওদিকে আছে। অনাথ। মেযেরা মাপ চেয়ে পিতাকেই নকল করে বেশি, পিতাব শিক্ষাই মেয়েদের জীবনে বেশি কার্যকর হয়। অনাথের প্রভাব আনন্দের জীবনে তুচ্ছ হতে পারে না। মালতীর সঙেগ পরিচয় করে মানুষ যে আজকাল খুশি হতে পারে না, অনাথ সমুদ্রতীরে এ কথা স্বীকার করেছে। অনাথের যদি এই জ্ঞান জন্মে থাকে, মেয়ের সম্বন্ধে সে কি সাবধান হয়নি ? অনাথ ওস্তাদ কারিগর, হ্রদায়ের প্রতিভাবান শিল্পী। আনন্দ হয়তো তারই হাতে গড়া মেয়ে। হয়তো মালতীর বিরুদ্ধ প্রভাবকে অনাথের সাহায্যে জয় করে করে তার হৃদয়-মনের বিকাশ আরও বিচিত্র, আরও অনুপম হয়েছে। ঘরে বসে হৃদয়ের দলগুলি মেলবার উপায় মানুযের নেই, মনের সামঞ্জস্য ঘরে সঞ্চয় করা যায় না। মন্দের সম্পর্কে না এলে ভালো হওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। জীবনের বৃক্ষ কঠোর আঘাত না পেলে মানুষ জীবনে পঙগু হয়ে থাকে, তরল পদার্থের মতো তার কোনো নিজস্ব গঠন থাকে না। আনন্দ হয়তো মালতীর ভিতর দিয়ে পৃথিবীর পরিচয় পেয়ে সম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। টবের নিস্তেজ অসুস্থ চাবাগাছ হয়ে থাকার বদলে মালতীর সাহায্যেই হয়তো সে পৃথিবীর মাটিতে আশ্রয় নেবার সুযোগ পেয়েছে, রোদ বৃষ্টি গায়ে লাগিয়ে আগাছার সঙ্গে লড়াই করে ও মাটির রস আকর্ষণ করে বেড়ে ওঠা। তবুর মতো সতেজ, সজীব জীবন আহরণ করতে পেরেছে।