পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in ՀԳ8 মানিক রচনাসমগ্ৰ তার এই সকরুণ অভিযোগে হেরম্বের সহানুভূতি জাগে না। আনন্দ মাির অবাধ্য জেনে সে খুশিই হয়ে ওঠে। আনন্দ বাপের দুলালী মেয়ে এ যেন তারই ব্যক্তিগত সৌভাগ্য। আনন্দের সম্বন্ধে প্রথমে তার যে আশঙ্কা জেগেছিল এবং পরে যে আশা করে সে এই আশঙ্কা কমিয়ে এনেছিল, তাদের মধ্যে কোনটি যে বেশি জোরালো এতক্ষণ হেরম্ব তা বুঝতে পারেনি। অনাথ এবং মালতী এদের মধ্যে কাকে আশ্রয় করে আনন্দ বড়ো হয়েছে সঠিক না জানা অবধি স্বস্তি পাওয়া হেরম্বের পক্ষে অসম্ভব ছিল। আনন্দের অন্তব অন্ধকার, এর ক্ষীণতম সংশয়টিও হেরম্বের সহ্য হচ্ছিল না। মালতীর আদেশের বিরুদ্ধেও তাকে প্ৰণাম করার মধ্যে তার প্রতি আনন্দের যতটুকু শ্রদ্ধা প্রকাশ পেল, হেরম্ব সেটুকু তাই খেয়াল করারও সময় পেল না। মালতীকে আনন্দ নকল করেনি শধু এইটুকুই তার কাছে হযে রইল প্রধান!! আনন্দের অকারণ ছেলেমানুষি ঔদ্ধতো তার দুঃস্বপ্নের ঘোর কেটে গেছে। আনন্দকে চোখে দেখে হেরম্বের মনে যে আবেগ ও মোহ প্রথমেই সঞ্চারিত হয়েছিল এতক্ষণে তার মনের সর্বত্র তা সঞ্চারিত হয়ে তার সমস্ত মনোধর্মকে আশ্রয় করেছিল। নিজেকে অকস্মাৎ উচ্ছসিত ও মুগ্ধ অবস্থায় আবিষ্কার করাব বিস্ময় অপনোদিত হয়ে গিয়েছিল। তাব মন সেই স্তরে উঠে এসেছিল যেখানে আনন্দের অনির্বচনীয় আকর্ষণ চিরন্তন সত্য। আনন্দকে চোখে দেখা ও তাব কথা শোনা হেবম্বের অভ্যাস হযে গিয়েছিল। নেশা জমে এলে যেমন মনে হয় এই নেশার অবস্থাটিই সহজ ও স্বাভাবিক, আনন্দেব সান্নিধ্যে নিজের উত্তেজিত অবস্থাটিও হেরম্বের কাছে তেমনি অভ্যস্ত। হয়ে এসেছিল। আনন্দ এখন তাকে আবার নতুন করে মুগ্ধ ও বিচলিত করে দিয়েছে। বয়স্ক হেবম্বের মনেও যে লোকটি এক রহস্যময। মাযালোকবাসী হয়ে আছে নিজেকে সেই অনাথের অনুরক্তা কন্যা বলে ঘোষণা কবে আনন্দ তাঁর আবিষ্ট মোহাচ্ছন্ন মনের উন্মাদনা আরও তীব্র আরও গভীর কিন্তু প্রেমিকের কাছে প্রেমের অগ্রগতির ইতিহাস নেই। যতদূরই এগিয়ে যাক সেইখান থেকেই আরম্ভ। আগে কিছু ছিল না। ছিল অন্ধকারের সেই নীরন্ধ কুলায়, যেখানে নব জন্মলাভের প্রতীক্ষাব্য কঠিন আস্তরণের মধ্যে হৃদয় নিস্পন্দ হয়ে ছিল। হেরম্ব জানে না তার আকুল হৃদযের আকুলতা বেড়েছে, এ শুধু বৃদ্ধি, শুধু ঘন হওযা। আনন্দের অস্তিত্ব এইমাত্র তার কাছে প্রকাশ পেয়েছে, এতক্ষণে ওব সম্বন্ধে সে সচেতন হল। এক মুহূর্ত আগে নয়। এক মুহূর্ত আগে তার হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হচ্ছিল কেবল শিরায় শিরায় রক্ত পাঠাবার প্রাত্যহিক প্রীতিহীন প্রয়োজনে । এইমাত্র আনন্দ তার স্পন্দনকে অসংযত করে দিয়েছে। আনন্দ বলল, কোথায় যােচ্ছ মা ? গা ধুতে হবে না, আরতি করতে হবে না? সন্ধ্যে হল, সে খেয়াল আছে। গোধূলি লগ্নে হেরন্সের কাছে আনন্দকে ফেলে মালতী উঠে চলে গেল। পৃথিবী জুড়ে নয়, এইখানে সন্ধ্যা নামছে। পৃথিবীর আর এক পিঠে এখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সমগ্রভাবে বিস্তৃত চলমান অবিচ্ছিন্ন দিন। এখানে যে রাত্রি আসছে তার নিজের দেহ দিয়ে সৃষ্টি করেছে মাটির পৃথিবী। পৃথিবী থেকে সূৰ্য যতদূর, মহাশূন্যে রাত্রির বিস্তার তার চেয়েও অনন্তগুণ বেশি। রাত্রির অন্ত নেই। মধ্যরাত্রিকে অবলম্বন করে কল্পনায় যতদূর খুশি চলে যাওয়া যাক, রাত্রির শেষ মিলবে না। পৃথিবীর এক পিঠে যে আলো ধরা পড়ে দিন হয়েছে, অসীম শূন্যের শেষ পর্যন্ত তার অভাব কোথাও মেটেনি।