পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in ՀԳN2 মানিক রচনাসমগ্ৰ সহজ অনুভূতিগুলো সহজ হয়েই আছে। মৃতা স্ত্রীকে কেউ ভুলে গেছে শুনলে খুশি হবার মতো হিংস্র আনন্দ নয়। কিন্তু আনন্দকে মিথ্যা কথা শোনানও হেরম্বর পক্ষে অসম্ভব। আমার স্ত্রীর কথা ভেবে বললেও দোষ হত না আনন্দ। সংসারে কত পরিচিত লোক কত আত্মীয় থাকে, যারা হঠাৎ আমাদের ছেড়ে চলে যায়। বেঁচে থাকবার সময় আমাদের কাছে তাদের যতটুকু দাম ছিল, মবে যাবার পর কেবল কাছে নেই বলেই তাদের সে দাম বাড়িয়ে দেওয়া উচিত নয়। দিলে মরণকে আমরা ভয় করতে আরম্ভ করব। আমাদের জীবনে মৃত্যুবা ছায়া পড়বে। আমবা দুর্বল অসুস্থ হয়ে পডব। কিন্তু-বলে আনন্দ চুপ করে গেল। হেরম্ব বলল, তুমি যা খুশি বলতে পাের আনন্দ, কোনো বাধা নেই। কথাগুলির মধ্যে আপনার স্ত্রী এসে পড়েছেন বলে সংকোচ হচ্ছে। যাই হােক, বলি। মনেব কথা চেপে রাখতে আমার বিশ্ৰী লাগে। আমার মনে হচ্ছে আপনার কথা ঠিক নয়। ভালোবাসা থাকলে শোক হবেই। শোক মিথো হলে ভালোবাসাও মিথো। হেরম্ব খুশি হল। প্রতিবাদ তার ভালো লাগে। প্রতিবাদ খণ্ডন করা যেন একটা জয়েব মতো। ভালোবাসা থাকলে শোক হয। আনন্দ। কিন্তু ভালোবাসা কতদিনের ? কতকাল স্থায়ী হয ভালোবাসা ? প্ৰেম অসহ্য প্রাণঘাতী যন্ত্রণাব ব্যাপার। প্রেম চিরকাল টিকলে মানুষকে আর টিকতে হত না। প্রোমেব জন্ম আব্ব মৃত্যুর মধ্যে ব্যবধান বেশি নয়। প্রেম যখন বেঁচে আছে তখন দুজনেব মধ্যে একজন মবে গেলে শোক হয়——অক্ষয় শোক হয়। প্রেমের অকালমৃত্যু নেই বলে শোকের মধ্যে প্রেম চিরন্তন হযো যায়। কিন্তু প্রেম যখন মরে গেছে, যখন আছে শুধু মায়া, অভ্যাস আব আত্মসাত্মনার খেলা, তখন যদি দুজনের একজন মরে যায়, বেশি দিন শোক হওযা অসুস্থ মনের লক্ষণ। সেটা দুর্বলতা আনন্দ। তুমি বোমিও জুলিয়েটের গল্প জান ? জানি। বাবার কাছে শুনেছি। প্রেমের মৃত্যু হবাব আগেই ওরা মরে গিয়েছিল। একসঙ্গে দুজনে মরে না গিয়ে ওদের মধ্যে একজন যদি বেঁচে থাকত, তার শোক কখনও শেয হত না। কিন্তু কিছুকাল বেঁচে থেকে ক্ৰমে ক্লামে ভালোবাসা মরে যাওয়ার পব ওদেব মধ্যে একজন যদি স্বৰ্গে যেত, পৃথিবীতে যে থাকত। চিবকাল তার শোকাতুর হয়ে থাকার কোনো কারণ থাকত না। একটা ব্যাপার তুমি লক্ষ করেছ আনন্দ % রোমিও জুলিয়েটের ট্র্যাজেডি তাদেব মৃত্যুতে নয়? কীসে তবে ৪৮ ওদেব প্রেমোব অসমাপ্তিতে। রোমিও জুলিযোটের কোনো দাম মানুযের কাছে নেই। জগতের লক্ষ লক্ষ বোমিও জুলিয়েট মরে যাক, কিছু এসে যায় না। কিন্তু ও ভাবে ভালো বাসতে বাসতে ওরা মরল কোন ভেবেই আমাদের চোখে জল আসে। আনন্দ আনমনে বলল, তাই কী? তা হবে বোধ হয়। হেরম্ব জোর দিয়ে বলল, হবে বোধ হয় নয়, তাই। ওদের অসম্পূৰ্ণ প্রেমকে আমরা মনে মনে সম্পূৰ্ণ করবার চেষ্টা করে ব্যথা পাই-রোমিও জুলিয়েটের ট্র্যাজেডি তাই। নইলে, ওদের জীবনে ট্র্যাজেডি কোথায়? ওরা দুজনেই মরে গিয়ে সব কিছুরই অতীত হয়ে গেল—ওদের জীবনে দুঃখ সৃষ্টি হবার সুযোগও ছিল না। আমরা সমবেদনা দেব কাকে? কীসের জোরে রোমিও জুলিয়েট আমাদের একফোটা অশ্রু দাবি করবে? ওরা তো দুঃখ পায়নি। প্রেমের পরিপূর্ণ বিকাশের সময। ওরা দুঃখকে এড়িয়ে চলে গেছে। আমরা ওদের প্রেমের জন্য শোক করি, ওদের জন্য নয়।