পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in ՀԳԵ- মানিক রচনাসমগ্ৰ দেখো জীবন নিয়ে মানুষ কী হইচই কবছে, কী প্রবল প্রতিযোগিতা মানুষের, কী ব্যস্ততা ! কাজ! কাজ! মানুষ কাজ কবছে! বউকে কঁদিয়ে বৈজ্ঞানিক খুঁজছে নূতন ফরমুলা, আজও খুঁজছে কালও খুঁজছে। দোকান খুলে বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞাপনে চারিদিক ছেয়ে ফেলে, উধ্বশ্বাসে ব্যবসায়ী করছে টাকা। ঘরেব কোণে প্ৰদীপ জেলে বসে বিদ্রোহী কবি লিখছে কবিতা, সারাদিন ছবি একে আর্টিস্ট ওদিকে মদ খেয়ে ফেনাচ্ছে জীবন। কেউ অলস নয়। আনন্দ, কুলি মজুর গাড়োয়ান তারাও প্রাণপণে কাজ করছে। কিন্তু কেন করছে আনন্দ ? পাগলের মতো মানুষ খালি কাজ করছে কেন? মানুষের কােজ নেই বলে। আসল কােজ নেই বলে। ছটফট করা ছাড়া আর কিছু করার নেই বলে। কিন্তু আসল কাজটা কী? মানুষের যা নেই ? এ প্রশ্নেরও জবাব নেই আনন্দ। মানুষের কী নেই তাও মানুষের বুঝবার উপায় নেই। কাজ না পেয়ে মানুষ অকাজ করছে এটা বোঝা যায়। কিন্তু তার কাজ কী হতে পারত তার কোনো সংজ্ঞা নেই। এর কারণ কী জান ? মানুষ যে স্তরের, তাব জীবনের উদ্দেশ্য সেই স্তরে নেই। ঈশ্ববের মতো, শেষ সত্যের মতো, আমিত্বের মানের মতো সেও মানুযের নাগালের বাইরে। জীবনের একটা অর্থ এবং পরিণতি অবশ্যই আছে, বিশ্ব-জগতে কিছুই অকারণ হতে পারে না। সৃষ্টিতে অজস্র নিয়মের সামঞ্জস্য দেখলেই সেটা বোঝা যায়। কিন্তু জীবনের শেষ পরিণতি জীবনে নেই। মানুষ চিরকাল তার সার্থকতা খুজবে কিন্তু কখনও তার দেখা পাবে না। যোগী ঋষি হার মানলেন, দার্শনিক হার মানলেন, কবি হাব মানলেন, অমার্জিত আদিমধ্যমী মানুষও হার মানলে। চিরকাল এমনি হবে। কাবণ সমগ্র সত্তাকে যা ছাডিযে আছে, মানুষ তাকে আয়ত্ত করবে। কী করে! কথা বলাব উত্তেজনায় হেরম্বর সাময়িক বিস্মৃতি এসেছিল। শব্দের মোহ তার মন থেকে আনন্দের মোহকে কিছুক্ষণের জন্য স্থানচ্যুত করেছিল। জীবন সম্বন্ধে বক্তব্য শেষ কবে পুনরায আনন্দের সান্নিধ্যকে পূৰ্ণমাত্রাব্য অনুভব করে সে এই ভেবে বিস্মিত হয়ে রইল যে, শ্রোতা ভিন্ন আনন্দ এতক্ষণ তার কাছে আর কিছুই ছিল না। আনন্দকে এতক্ষণ সে এমনি একটা সাধারণ পর্যাযে ফেলে রেখেছিল যে শ্রবণশক্তি ছাড়া ওর আর কোনো বিশেষত্বের সম্বন্ধেই সে সচেতন হয়ে থাকেনি। হেরম্ব বোঝে, বিচলিত হবার মতো ত্রুটি অথবা অসঙ্গতি এটা নয়। কিন্তু ছেলেমানুযেব মতো। তবু সে আনন্দের প্রতি তার এই তুচ্ছ অমনোযোগে আশ্চর্য হয়ে যায়। হেরম্ব এটাও বুঝতে পারে, তার কাছে জীবনের ব্যাখ্যা শুনতে আনন্দ ইচ্ছক নয়। জীবন কী, জীবনের উদ্দেশ্য আছে কী নেই, এ সব তত্ত্বকথায় ওর বিরক্তি বোধ হচ্ছিল। অন্য সময় বিশ্লেষণ ওর ভালো লাগে। কিনা হেরম্ব জানে না, কিন্তু আজ সন্ধ্যায় তার মুখের বিশ্লেষণ ওর কাছে শাস্তির মতো লেগেছে। সে থেমে যেতে আনন্দ স্বস্তি লাভ করেছে। রোমিও জুলিয়েটের কথা বলুক, প্ৰেমেব ব্যাখ্যা করুক, আনন্দ মন দিয়ে শুনবে। কিন্তু সেইখানেই তার ধৈর্যের সীমা। অনুভূতির সমন্বয় করা জীবনের সমগ্রতাকে সে জানতে চায় না, বুঝতে চায় না, ভাবতে চায় না। তাই হোক। তাই ভালো। হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, চন্দ্ৰকলা নাচটা কী আনন্দ ? আনন্দ বলল, ধরুন, আমি যেন মরে গেছি। অমাবস্যার চাঁদের মতো আমি যেন নেই। প্রতিপদে আমার মধ্যে একটুখানি জীবনের সঞ্চার হল। ভালো করে বোঝা যায় না। এমনই একফেঁটা একটু জীবন। তারপর চাঁদ যেমন কলায় কলায় একটু একটু করে বাড়ে আমার জীবনও তেমনই করে বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে যখন পূর্ণিমা এল, আমি পূৰ্ণমাত্রায় বেঁচে উঠেছি। তারপর একটু একটু করে g এ নাচ ভালো নয়, আনন্দ । কেন ? একটু একটু করে মর্যার নাচ নেচে তোমার যদি সত্যি সত্যি মরতে ইচ্ছা হয় ?