পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in \Ο Σ. Ο মানিক রচনাসমগ্র অশোকের স্তিমিত চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। হেরম্ব স্পষ্ট দেখল। অসুস্থ স্বামীর লাঞ্ছনীয় সুপ্রিয়ার মুখও ব্যথায় স্নান হয়ে গেছে। কিন্তু হেরম্বের মধ্যে যে নিষ্ঠুরতা মরে যাচ্ছিল। আজ তা মরণ-কামড় দিতে চায়। গলা নামিয়ে সে যোগ দিল, তুমি গৃহস্বামী যে! অশোক দেয়ালের দিকে মুখ করে বলল, না। --না। হেরম্ব শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করল, কি না, অশোক ? গৃহস্বামী অসুস্থ। তার কর্তব্য নেই। হেরম্ব বলল, তাহলে তোমায় বিরক্ত করা উচিত হবে না। আমরা অন্য ঘরে যাই। হেরম্ব ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সুপ্রিয়া তাকে অন্য একটি ঘরে যে ঘরের মেঝেতে শুধু মাদুর পাতা ছিল, নিয়ে গিযে বলল, বসুন। ওকে একটু শান্ত করে আসি। পারবি না, সুপ্রিয়া, ও একটা আস্ত বঁােদর। গালাগালি কেন ? বলে সুপ্রিয়া চলে গেল। শুধু একটা মাদুর বিছানো, একটা বালিশ পর্যন্ত নেই। মাদুরটা দেয়ালের কাছে সরিয়ে নিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে হেব্বস্ব আরাম করে বসল। হেরম্বের প্রাণশক্তি অপরিমেয়, ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাত, চেতনাব বাদ-বিসংবাদ সহ্য করার ক্ষমতা তার অনমনীয়, কিন্তু আজ সে অপরিসীম শ্রান্তি বোধ করল। দুঃখ, বিষাদ বা আত্মাগ্লানি নয়, শুধু শ্রান্তি। সুপ্রিয়ার প্রত্যাবর্তনের আগে এই বাড়ি ছেড়ে, আনন্দের সঙ্গে দেখা হবাব আগে পুরী থেকে পালিয়ে, চিরদিনের জন্য নিরুদেশ যাত্রা করতে পেলে সে যেন এখন বেঁচে যায়। হেরম্বের ঘুম আসে,-এক সদয় দেবতার আশীর্বাদের মতো। সে চোখ বোজে। একটা ব্যাপার সে বুঝতে পেরেছে। আনন্দের বিষগ্ন, বিরস প্রহরগুলিব জন্ম-ইতিহাস। আর এ কথা অস্বীকার করাব উপায নেই যে, যে কারণে না মরে তার পুনর্জন্ম সম্ভব নয়, সেই কারণেই তার ক্ষয় পাওয়া তুদয়েবও পুনরুজজীবন অসম্ভব হয়ে গেছে। তার জীবনে প্রেম। এসেছে অসময়ে। প্রোমেব সে অনুপযুক্ত। বসন্ত-সমাগমে অর্ধমৃত তরুর কতগুলির পল্লব কুসুমাতীৰ্ণ হয়ে গেছে বটে, কিন্তু কত শুষ্ক শাখায় জীবন নেই, কত শাখার বল্কল পিপীলিকা-বাস জীর্ণ। তার অকাল-বার্ধক্যের সঙ্গে আনন্দের অহরহ। পরিচয় ঘটে, আনন্দের কত খেলা তার প্রিয় নয়, আনন্দের কত উল্লাস তার কাছে অর্থহীন। আনন্দ তা টের পায়। কত দিক দিয়ে আনন্দ তার সাড়া পায় না, যদি বা পায় তা কৃত্রিম, মন রাখা সাড়া। আনন্দ বিমর্ষ হয়ে যায়। মনে করে, হেরম্বের প্ৰেম বুঝি মরে যাচ্ছে। হেরম্বের প্রেমই যে দুর্বল এখনও সে তা টের পায়নি। সুতবাং আনন্দকেও সে ঠকিয়েছে। জীৰ্ণবিশিষ্ট যৌবনের সবখানিই প্রায় তাকে ব্যয় করতে হয়েছে আনন্দকে জয় করতে, এখন তাকে দেবার তার কিছু নেই। এ কথা তার জানা ছিল না যে, পরিপূর্ণ প্রেমের অনন্ত দাবি মেটাবার ক্ষমতা আছে একমাত্র অবিলম্বিত, অনপচয়িত, সুস্থ ও শুদ্ধ যৌবনের। অভিজ্ঞতায় প্রোমেব খোরাক নেই, মনস্তত্ত্বে বুৎপত্তি প্রেমকে টিকিয়ে রাখার শক্তি নয়। নারীকে নিয়ে একদিনের জন্যও যে খেয়ালের খেলা খেলেছে, তুচ্ছ সাময়িক খেলা, প্রেমের উপযুক্ততা তার ক্ষুন্ন হয়ে গেছে। মানুষের জীবনে তাই প্ৰেম আসে একবার, আর আসে না, কারণ একটি প্রেমই মানুষের যৌবনকে ব্যবহার করে জীর্ণ করে দিয়ে যায়। হৃদয় বলে মানুষের কাব্যে উল্লিখিত একটি যে শতদল আছে, তার বিকাশ স্বাভাবিক নিয়মে একবারই হয়, তারপর শুরু হয় ঝরে যাবার আয়োজন। সাধারণ হৃদয়, প্রতিভাবানের হৃদয়, সমস্ত হৃদয় এই অখণ্ডনীয় নিয়মের অধীন, কারও বেলা এর অন্যথা নেই। সুপ্রিয়ার ফিরতে দেরি হল। সে একেবারে হেরম্বের খাবার নিয়ে আসায় বোঝা গেল যে, শুধু অশোককে শান্ত করতেই তার এতক্ষণ সময় লাগেনি। খাবার খেয়ে ঠান্ডা হয়ে হেরম্ব বলল, তোর উপরে রাগ হচ্ছিল, সুপ্রিয়া।