পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in võ8O মানিক রচনাসমগ্ৰ নিতাই ডাকিয়া বলে, কী মাছ পড়ল মাঝি ? নবীন বলে, মাছ কোথা ঘোষ মশায় ? জল বড়ো বেশি গো ! মাগুরটাগবি পেলি নবীন ? পেলে আমাকে একটা দিস। ছেলেটা কাল পথ্যি করবে। নবীন মিথ্যা জবাব দেয়। বলে, জলে দেড়িয়ে কি মিছে কথা কইছি? এত জলে মাছ পড়ে না। ইদিকে তিন হাত ফাক রইছে দেখছনি ? হারুর মরণের খবরটা সে শান্তভাবে গ্রহণ করে। বলে, লোক বড়ো ভালো ছিল গো । জগতে শত্ত্বর নেই। তারপর বলে, ই বছবি, জানি ঘোষ মশায়, অদেষ্ট সবার মন্দ । তিন বর্ষা নাবল না, এর মধ্যে জল কামডাতে নেগেছে । দিন নাই রাত্ৰি নাই। জলেস্থলে নবীনের কঠোর জীবন সংগ্রাম। দেহের সঙ্গে মনও তাহার হাজিযা গিয়াছে। হারুব অপমৃত্যুতে বিচলিত হওযার সময় তাহার নাই। অথচ এদিকে মমতাও জানে। দশ বছরের ছেলেটা বিকাল হইতে পুলের উপর ঠিায় দাঁড়াইয়া আছে। জলে নামিযা বাপের মতো সেও মাছ ধরিতে চায়। কিন্তু নবীন কোনোমতে অনুমতি দিবে না। রেতে লয বাপ, জব হবে। কাল বিহানে আসিস। বিহনে জল বইবেনি বাবা । হ্র, রইবেনি আবাব। তেগব ডুব জল হবে জানিস। পুল পাব হই যা কিছু দূর অবধি রাস্তার দুপাশে শুধু চযা খেত। তারপর গ্রাম আরম্ভ হইয়াছে। এদিকে বসতি কম। রাস্তাব দক্ষিণে ঝোপঝাপের বেষ্টনীব মধ্যে পৃথক কয়েকটা ভাঙাচোবা ঘর বৃষ্টিতে ঘরে বাইরে ভিজিযাছে। ওখানে সাত ঘর বাগদি বাস করে। গ্রামের ছেলেমেয়েদেব মধ্যে এবাই সবচেযে গরিব, সবচেযে ছোটােলোক, সব চেয়ে চাের। দিনে ওরা যে গৃহস্থের চালু মেরামত কবে, রাত্রে সুযোগ পাইলে তাহাবই ভিটায় সিঁদ দেয়। কেহ না কেহ ওদের মধ্যে ছমাস একবছর জেলেই পড়িয়া আছে। ছাড়া পাইবাব পৰ্ব্ব গ্রামে ফিরিয়া বলে, শ্বশুর ঘর থে, ফিবালুম দাদা। বেশ ছিলাম গো! এটুকু পাব হইয়া গেলে বসতি ঘন হইয়া আসে। বাড়ি ঘরের উন্নত অবস্থা চোখে পড়ে। পথেৰ দুদিকেই দুটি একটি শাখাপথ পাডার দিকে বাহির হইয়া যাইতে আরম্ভ করিষাছে দেখা যায়। মাঝে মাঝে কলাবাগান সুপারি বাগান ও ছোটাে ছোটাে বঁাশঝাড় ডাইনে বঁায়ে আবির্ভূত হয়। আমবাগানকে অন্ধকারে মনে হয় অরণ্য। কোনো কোনো বাড়িব সামনে কামিনী, গন্ধরাজ ও জবাফুলেব বাগান করিবার ক্ষীণ চেষ্টা চোখে পড়ে। ক্ৰমে দু-একটি পাকা দালানের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। বাড়িগুলি আগাগোড়া দালান নয, এক ভিটায় দুখানা ঘর হয়তো ইটের, বাকিগুলি শণে ছাওয়া চাচের বেড়ায় নির্জন স্তব্ধ পথে শববাহী তাহারাই জীবনের সাড়া দিয়া চলিয়াছে। শশীর বিষগ্নতা ঘুচিবার নয়। আলো হাতে সকলের আগে আগে সে যাইতেছিল। নিতাই সুদেব ওরা কথা কহিতেছে, সকলেই, কথা নাই কেবল শশীব মুখে। পথের ধারে কোনো বাড়িতে আলো জ্বলিতেছে দেখিলে তাহার ইচ্ছা! হয় হাঁক দিয়া বাড়ির লোকের সাড়া নেয়। এক মিনিট দাঁড়াইয়া অকারণে বাড়ির সকলের কুশল জিজ্ঞাসা করে। তাহার সাড়া পাইয়া কান্নার রোল তুলিবে না। এমন একটি পরিবারের খবর না লইয়া হারুর বাড়ির দিকে চলতে সে যেন জোর পাইতেছিল না। খানিক আগাইয়া বাজার।