পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOOkS. in পুতুলনাচের ইতিকথা w8 উঠিল কী কবিয়া ? স্বতন্ত্র মনে হয় শুধু ভুজঙ্গাধরকে, বাজিতপুরে সে ছিল এক উকিলের মুহুরি, টাকার গোলমালে দুবছর জেল খাটিয়া আসিয়াছে। বেশি কথা ভূজঙগাধর বলে না, ছোটাে ছোটো কুটিল চোখের চাহনি চঞ্চল ভাবে এদিক ওদিক ঘুরিয়া বেড়ায়, মনে হয় কী যেন সে মতলব আঁটিতেছে, গোপন ও গভীর। কীর্তি নিয়োগীর মাথা জুড়িয়া চকচকে টাক, একদিন পিওনের হলদে। পাগড়িতে ঢাকা থাকিত, এখন টাকের উপর আলুর মতো বড়ো আবটি দেখিয়া হাসি পায়। ইহার প্রতি শ্ৰীনাথের শ্রদ্ধা গভীব, কেন সে কথা কেহ জানে না। কীর্তির কথাগুলি শ্ৰীনাথ যেন গিলিতে থাকে। কীর্তি একটি পয়সা বাহির করিয়া বলে, ও ছিনাথ, সাবু দিয়ো দিকি এক পয়সার।--শ্ৰীনাথ এক পয়সায় যতটা সাণু কাগজে মুডিয়া তাহাকে দেয় তাহা দেখিয়া সকলে যেন ঈৰ্ষা বোধ করে, ভূজঙ্গাধরের সাপের মতো চোখ দুটিতে কয়েকবার পলক পড়ে না। উপরে ঝোলানো কেরাসিনের আলোটাতে শ্ৰীনাথের দোকানে আলো মন্দ হয় না, দোকানের সাজানো জিনিসগুলিতে যেন একটি লক্ষ্মীশ্ৰী ছড়ানো থাকে। ছোটো ছোটো চৌকো কাঠেব খোপে চাল ডাল, একটা ময়দার বস্তা, বারকোশে বসানো তোলেব গাদ মাখা পাত্ৰ, মুড়িমুড়কিব দুটি জালা, হরিণেব ছবি আটা দেশলাই-এর প্যাক, একদিকে কাঁচ বসানো হলদে টিনে সাগু বার্লি, গোল গোল লিজেঞ্জ,-ভুজঙ্গাধর চারিদিকে চোখ বুলায,--শ্ৰীনাথের বসিবার ও পয়সা রাখিবাব চৌকো ছোটাে চোকিটি ভালো করিয়া দেখিবার ভূমিকাব মতো। সামনে পথ দিয়া আলো হাতে, কেহ হাঁটিয়া যায়, কেহ যায় বিনা আলোতে, শ্ৰীনাথের একটি দুটি খদের আসে। ৬পস্থিত একজন খদেরকে সে ভূতের মৃত্যু-সংবাদ শোনায়।-না, যে বিষয়েই আলোচনা চলুক তুতোব কথাটা তাহাবা ভোলে নাই। শশী উঠি-উঠি কবি তেছিল, এমন সময় সকলকে অল্পবিস্তব অবাক করিয়া এক হাতে ক্যাম্বিশের ব্যাগ, এক হাতে লাঠি, বগলে ছাতি, পায়ে চটি, গায়ে উড়ানি যাদব পণ্ডিত পথ হইতে শ্ৰীনাথের দোকানেব সামনে উঠিযা আসিলেন। মানুষটা বুড়া, শরীরটা শীর্ণ, কিন্তু হাড় কখানা মজবুত । বিদ্যা যাদবের বেশি নয়, পণ্ডিত বলিয়া খ্যাতিও তাহার নাই, ধামিক ও অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন বলিযাই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। গৃহস্থ যোগী। তিনি, সংসারী সাধক। স্পর্শ করিবার অধিকাব যাহাঁদের আছে দেখা হইলে পায়ের ধুলা নেয়, অপরে। সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত করে। সাধনপথের কতগুলি স্তর যাদব অতিক্ৰম কবিয়াছেন, কেহ জানে না, ভক্তি যাদের উচ্ছসিত তারা সোজাসুজি সিদ্ধিলাভের কথাটাই বলে। যাদব নিজে কিছু স্বীকার করেন না, প্রতিবাদও করেন না। কায়েতপাড়ার পথের ধারে, যামিনী কবিরাজের বাড়ি ও শশীদের বাড়ির মাঝামাঝি একটি ছোটো একতলা বাড়িতে যাদব বাস করেন। এ৩ পুরাতন, এমন জীর্ণ বাড়ি এ অঞ্চলে আর নাই। বাড়ির খানিকটা অংশ ভাঙিয়া পডিয়াছে। এককালে চারিদিকে বোধ হয় প্রাচীর ছিল। এখন ছড়ানো পড়িয়া আছে শ্যাওলা ধরা কালো কালো ইট। যাদব বাস না করিলে বাড়িটা অনেকদিন আগেই ভূতের বাড়ি বলিয়া খ্যাতি লাভ করিত। স্ত্রী ছাড়া সংসারে যাদবের কেহ নাই। পাগলাটে স্বভাবের জন্য গ্রামের ছেলে বুড়ো যাদবের স্ট্রীকে পাগলদিদি বলিয়া ডাকে। কয়েক দিন আগে যাদব কলিকাতায় গিয়াছিলেন। আজ তাহার ফিরিবাব কথা নয়। সকলে শশব্যাস্তে প্ৰণাম করিয়া বসিতে দিল। পঞ্চানন জিজ্ঞাসা করিল, হঠাৎ ফিরে এলেন পণ্ডিত মশায় ? যাদব বলিলেন, গেয়ো মানুষ, শহরে মন টিকল না। বাবা। শ্ৰীনাথ উচ্ছসিত ভাবে বলিল, আপনারও মন টেকটেকি দেবতা! এ কথায় যাদব হাসিলেন। উচ্ছসিত ভক্তিকে গ্ৰহণ করবার পদ্ধতি তাহার এই। একে একে সকলের তিনি কুশল প্রশ্ন করিলেন। ভুতোর মৃত্যু-সংবাদে দুঃখিত হইয়া বলিলেন, আহা! কিন্তু বিশেষ বিচলিত হইলেন না। জীবন-মরণ যাহার নিকট সমান, দুরন্ত একটা বালকের মৃত্যুতে বিচলিত হওয়ার