পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOOkS. in পুতুলনাচের ইতিকথা V)(S প্রকৃতিকে, মতি এত বেশি করিয়া চেনে যে আকাশের রামধনু ছাড়া তাহার চোখ তাহার মন কোথাও রং খুজিয়া পায় না। নাকের সামনে কচি কিশলয়ের মৃদু হিন্দােল কোন কঁচা মনকে দোল দেয় কে জানে, মতির মনকে দেয় না। সর্বাঙ্গের শুভ্রতায় তালগাছের রহস্যময় ছায়া মাখিয়া মাখিয়া থাকে। আকাশে ভাসে উজ্জ্বল সাদা মেঘ। আর বন্য কপোতেব বঁাক। শালিখা পাখি উড়িবার সময় হঠাৎ শিস দেয। অল্প দূরে কাতীেরা পাখির পাঠশালা বসে। বাতাসে থাকে কত ফুল, কত মাটি, কত ডোবার মেশানো গল্পী । মতি কিছু দ্যাখো না, কিছু শোনে না, কিছু শোকে না। তালপুকুরের নির্জনতাকে সে শুধু ভোগ করে গায়ে জড়ানো আঁচলটি কোমরে বাধিয়া। গা উদলা করিয়া দেওয়াতেও কেহ যে তাহাকে দেখিতে পাইতেছে না। ইহাতে মতির ভাবী মজা লাগে। সংসারের কাজ না করিলে কুসুম তাহাকে বকে। তালপুকুবের ধারে কাজ ফাঁকি-দেওয়া আলস্যাটুকু মতি ভোগ করে ভবিষ্যতেব চিন্তা করিতে করিতে। সুদেবকে মনে মনে মরিবার আশীর্বাদ কবিয়া আরম্ভ না করিলে ভবিষ্যতেব ভাবনাটা তাহার যেন ভালো খোলে না! মতির দর্শনী ইচ্ছা, বড়োলোকের বাড়িতে শশীর মতো ববের সঙেগ তাব বিবাহ হয়। কাজ নাই, বকুনি নাই, কলহ নাই, নোংরামি নাই, বাড়ির সকলে সর্বদা পরিষ্কাব পরিচ্ছন্ন থাকে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, হাসে, তাস-পাশা খেলে, কলের গান বাজায়, আর,--আর বাড়ির বউকে খালি আদর করে। চিবুক ধরিয়া তাহার লজ্জিত মুখখানি তুলিয়া বলে, লক্ষ্মী বউ, সোনা বউ, এমন না হলে বউ ? বলে, বাড়ি আলো হল! স্বপ্ন মতির অফুরন্ত। মস্ত একটি ঘরের এক কোণে সে বসিয়া আছে। সর্বাঙ্গে তাহার ঝলমলে গহনা, পরনে ঝকঝকে শাড়ি। ঘোমটার মধ্যে চন্দনচর্চিত মতির মুখখানি কী রাঙা লজ্জায়! আনন্দে সে ছোটাে ছোটাে নিশ্বাস ফেলিতেছে আর শুনিতেছে। ঘরের বাহিরে বড়োলোকের বাড়ির প্রকাণ্ড সংসারের কলরব। শশীর বোনেব মতো পাড়াবা কে যেন একটি মেয়ে মতির সঙ্গে ভাব করি যা গেল। যামিনী কবিরাজের বউয়ের মতো সুন্দরী একটি মহিলা, মতির বোধ হয সে ননন্দই হইবে, পানের বাটা সামনে দিযা বলিল, পান সাজো, বউ। ও সোনা-বউ, পান সাজো । তারপব কে বলিল, বিউমাকে খেতে দে তোরা কেউ একজন । যেই বলুক, তালপুকুরের ধারে প্রকৃতির মহােৎসব হইতে বাড়ি ফেরার সময় মতি আবার তীব্র ভাবে ইচ্ছা কবে সুদেব ব্যাটা মরিয়া যাক। কুসুমেব সঙ্গে আজকাল প্রায়ই ঝগড়া বাধে মতির। সকলের অগোচরে মতিকে কুসুম শশীর কথা তুলিযা অন্যায় পরিহাস করিতে আরম্ভ করিয়াছে। বলে, শরীর খারাপ লাগছে মতি ? তাই চুপ করে বসে রয়েছিস ? আহা, যাট। ছোটােবাবুকে ডাকব ? পবীক্ষে করে ওষুদ দেবে? মতি বলে, কেন লাগতে এলি বউ ? তোর আমি কী করেছিা! কুসুম বলে, চোখ ছলছল করছে। দেখলে ছােটােবাবুর বুক ফেটে যাবে। মতি বলে, যমের অরুচি। মরা তুই, মর। কুসুম তবু বলে, জানিস লো মতি,-রাতে তোর কথা ভেবে ছােটােবাবুর ঘুম হয় না। বসে বসে মালা জপ করে, মতি, মতি, মতি। সুদেবের সঙ্গে তোর নিকে হয়ে গেলে ছোটোবাবু তালপুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করবে।