পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOOkS. in পুতুলনাচের ইতিকথা SVS) বিন্দু বলিল, না। আমি হাবভাব দেখিয়ে ভুলিয়েছিলাম বলে। কিন্তু তা তো তুই কবিসনি? তুই তখন কতটুকু ! ও তাই মনে করে দাদা। বিন্দুর শুষ্ক চোখ এতক্ষণ জ্বলজ্বল করিতেছিল, আবার স্তিমিত সজল হইয়া আসিল। চোখ মুছিয়া বলিল, কেন মিথ্যে তোমায় বললাম। শশী ভাবিতেছিল, বিন্দুর কথায় চমকাইয়া গেল। এমন হতাশ হইযা গিয়াছে বিন্দু ? ভাবিতে ভাবিতে শশীর মুখ কালো আর কঠিন হইয়া ওঠে। অন্যদিকে চাহিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল, নন্দ আব কাউকে আনে,--বন্ধুবান্ধব ? বিন্দু বলিল, না না, ছি, ও সব বুদ্ধি নেই। যা শাস্তি দেবার নিজেই দেয়। তারপরে মৃদুস্বরে আবার বলিল, অসুখ-বিসুখ হলে খুব ভাবে দাদা, সেবাও কবে। শশী অনেকক্ষণ ভাবিল। আমার সঙেগ চলে যাবি বিন্দু ? বিন্দু উৎসুক হইয়া বলিল, কোথায় ? কোথায় যাব তোমার সঙ্গে ? শশী বলিল, কাল আমরা দেশে চলে যাই,--যাবি ? বিন্দু ব্যঞ্জ’ স্পাইযা বলিল, যাব। চলো এখুনি বেরিয়ে পড়ি দাদা, হঠাৎ যদি এসে পড়ে ? বিন্দুরা যেন এক মিনিটও সবুর সহিবে না। এতকাল এখানে সে কেমন করিয়া ছিল কে জানে! গাড়িতে শশী তাহাকে এই কথাই জিজ্ঞাসা করিল। পথের পাশে সাজানো দোকানের দিকে চোখ রাখিয়া বিন্দু বলিল, ভেবেছিলাম ক্ষমা করবে। এতকাল পাবে। এ কী প্রত্যাবর্তন বিন্দুর ? গহনা কই, কাপড় কই, মোটবহার কই? গ্রামের লোক অবাক মানিল। বিন্দুকে জ্বালাতনও কম কবিল না। ব্যাপারটা বুঝিবার জন্য সকলেই উৎসুক। জেরায় জেরায় বাহিরে পুরুষদের এবং ভিতবে মেয়েদের জীবন অতিষ্ঠ হইয়া উঠিল। শশী আর বিন্দু নিজে ছাড়া কেহ কিছু জানিত না, কেহ কিছু জানিতেও পারিল না। তাই মুখে মুখে নানা কথা প্রচারিত হইয়া গেল । সেনদিদিই বিন্দুকে যন্ত্রণা দিল সবচেয়ে বেশি। শশীকে অবাক করিয়া কিছুদিন হইতে সেনদিদি হামেশা এ বাড়িতে আসিতেছিল। গোপালের সঙ্গে তার যেন একটা সন্ধি হইয়াছে। কৃর্তায় তুড়ি ঢাকিয়া গোপাল তামাক টানে, অদূরে পিড়ি পাতিয়া বসিয়া সেনদিদি তার সঙ্গে করে আলােপ। সেনদিদির দাগি মুখ আব্ব কানা চােখ দেখিয়া গোপালেরও যেন একটা রোগ আরাম হইয়া গিয়াছে। আজকাল সে প্রসন্ন, প্রশান্ত। গ্রাম্য রমণীর আবেগপূর্ণ মমতায় সেনদিদি শশীকে আকর্ষণ করিত বটে এবং লাবণ্যবতীর স্নেহ স্বভাবতই মানুষ একটু বেশি পছন্দ করে বলিয়া সে মমতা দামিও ছিল শশীব কাছে। কিন্তু এ কথা শশী কখনও বিশ্বাস করে নাই যে পড়ন্ত সূর্যের মতো শেষ যৌবনের অত্যাশ্চর্য বুপের অস্ত্রে ছেলেকে বশ কবি যা গোপালের উপব একটা উপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণের এতটুকু ইচ্ছাও সেনদিদির ছিল। গোপালের বাঁকা মন বঁকা মানে খুজিত। তাই সেনদিদির বর্তমান শ্ৰীহীনতায় গোপালের প্রসন্নভােব শশী বুঝিতে পারে। বুঝিতে পারে না সেনদিদির আসা-যাওয়া। চিরকাল যে শত্ৰুতা করিয়াছে, ক্ষতি করিয়াছে অপূরণীয়, তার সঙ্গে বসিয়া সেনদিদি যে গল্প করিতে পাবে, শশীকে তা যেন অপমান করে। মাঝে মাঝে হাসির কথাও বুঝি বলে গোপাল, কারণ, সেনদিদির কুশ্রী মুখখানা অনিন্দ হাসিতে ভরিয়া যাইতেও দেখা যায়। শশী জানে, খুব অল্প বয়সে সেনদিদির ভার গোপালের ঘাড়ে পড়িয়াছিল। তারপর কত টাকার বিনিময়ে সেনদিদিকে গোপাল যামিনীর কাছে বিসর্জন দিয়াছিল।