পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in VSOSbr মানিক রচনাসমগ্র কুমুদ বলিল, ভিন্ন ঘরা হলে মন্দ হয় না। শশী—দু-চার ঘণ্টা একা না থাকতে পারলে কি চলে ? কবিতা লিখিস, অ্যা? না। ঠিকমতো বাঁচতেই জানি না, কবিতা লিখব ! লিখতে লজা করে। কুমুদ লজ্জায় কবিতা লেখে না এটা আশ্চর্য মনে হয়। জীবনে সে কী চায় আজও কি কুমুদ তাহা বুঝিতে পারে নাই ? জীবনকে লইয়া আজও সে পরীক্ষা করিয়া চলিয়াছে? কোন সাগরে মুক্তা আহরণ করিবে তারই অন্বেষণে সাত সাগরে ভাসিয়া বেড়াইতেছে? এর চেয়ে বিস্ময়কর কিছু নাই যে শান্ত আর বন্য কোনো মানুষই জীবনের রহস্য ভেদ করিয়া সেই চিরন্তন স্থিতির খোঁজ পায় না, যা অপরিবর্তনীয় হইলেও চলে, যেখানে অভিনবত্ব কামা নয় মানুষেবা। শশীর মতো জীবনকে কুমুদ আজ মন্থর করিতে চায় ; আর শশী প্রার্থনা করে কুমুদের অতীত দিনের উত্তপ্ত উচ্ছল জীবনের আবর্ত! সুখ যে তাতে বিশেষ হইবে না তা জানে শশী। তবু মন কেমন করে। কুমুদ যে কেন গাওদিয়ায় আসিয়াছে শশী ঠিক তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না। কত দিন থাকিবে তাই বা কে জানে। জিজ্ঞাসা করিলে কুমুদ সেই একই জবাব দেয়, যত দিন থাকতে দিবি। এ কথার কোনো মানে হয় না। সে যদি ছমাস একবছরও এখানে থাকিয়া যায, শশী কী তাহাকে বলিবে যে এবার তুমি বিদেয় হও? কুমুদের মধ্যে একটা নূতন পরিবর্তন এবার শশীর চোখে ধরা পড়িতেছিল। সেবার তাহার মুখে চোখে কথায় ব্যবহারে যাত্ৰাব দলে অধঃপতনের পরিচয় ছিল স্পষ্ট,----এবার সে যেন বহুদিন আগেকাব মতো কবি ও ভাবুক হইয়া উঠিয়াছে। কেবল পুরানো দিনের মতো এবার আর তাহার বিদ্রোহী উদ্ধত ভাব নাই। কী যেন সে ভাবে, কী এক রসালো ভাবনা, চােখের দৃষ্টি তাহাব হইয়া আসে। উৎসুক এবং একান্ত বেমানানভাবে সেই সঙ্গে মুখে ফুটিয়া থাকে গভীর সন্তোষ। তা ছাড়া, গাওদিযার মাঠে ঘাটে ঘুরিয়া বেড়ানোর মধ্যে কী রস সে আবিষ্কার করিয়াছে সেই জানে, —সময় নাই, অসময় নাই, কোথায় যেন চলিয়া যায়। একদিন শশী জিজ্ঞাসা করিল, বিনোদিনী অপেরার কী হল রে কুমুদ ? কুমুদ বলিল, ও দলটাি ছেড়ে দিয়েছি। বৈশাখ মাসে সরস্বতী অপেরা বলে আরেকটা দলে ঢুকব,--- কথাবার্তা সব ঠিক হযে আছে। এরা মাইনে অনেক বেশি দেবে। এখনই যোগ দেবার জন্য বুলো বুলি করছিল, কিন্তু পার্ট বলে বলে কেমন বিরক্তি জন্মে গেছে ভাই, তাই ভাবলাম কটা মাস একটু বিশ্রাম করেনি। কে জানে এ কথা সত্য কী মিথ্যা। শশীর মনে একটা সন্দেহ উকি দিয়া যায়। সে ভাবে যে হয়তো বিনোদিনী অপেরা হইতে কুমুদকে বিদায় করিয়া দিয়াছে, কোথাও কিছু সুবিধা করিতে না পারিয়া সে আসিয়া আশ্রয় লইয়াছে এখানে-সরস্বতী অপেরার কথাটাও বানানো : টাকাকড়ি কিছুই হয়তো কুমুদের নাই। একদিন শশী বলিল আমায় গোটা পনেরো টাকা দিবি কুমুদ ? হাতে নগদ টাকা নেই, একজনকে দিতে হবে। কুমুদ তাহার সুটকেস খুলিল, এ কোণ ও কোণ হাতড়াইয়া বলিল, আমার মনিব্যাগ? শশী ভাবিল, হ্রঃ এবার মনিব্যাগ তোমার চুরি যাবে! ছি কুমুদ, আমার সঙ্গে শেষে তুই ছলনা আরম্ভ করেলি! কিন্তু না, ব্যাগ আছে। জামা কাপড় নামাইয়া খুজিতেই ব্যাগটা বাহির হইয়া পড়িল। কুমুদ বলিল, তোর কাছে রাখতে দেব ভেবে একেবারে ভুলে গিয়েছি। ভাই, চুরি গেলেই হয়েছিল আর কী! যা দরকার নিয়ে রেখে দে ব্যাগটা তোর কাছে।