পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in 88 মানিক রচনাসমগ্র চিঠির জবাব আমি দিচ্ছিনে। --কদিন পরে শীতলের কাছে রাখালের একখানা পোস্টকার্ড আসিল, শ্যামা চিঠিখানা পুড়াইয়া ফেলিল, শীতলকে কিছু বলিল না। জবাব না পাইয়া একটু অপমান বোধ করুক লোকটা। ফাকি দিয়া টাকা বাগাইয়া লওয়ার জন্য শীতল তাহাকে এমন ঘূণাই করিতেছে যে চিঠির উত্তরও দেয় না। ফাল্লুন মাস কাবার হইয়া আসিল। শীত একেবারে কমিয়া গিয়াছে। একদিন রোদ খাওযইয়া লেপগুলি শামা তুলিয়া রাখিল।। শ্যামার শরীরটা আজকাল ভালো আছে, তিন ছেলের মার আবাব শরীব—তবু, সানন্দ মনে আরেকটি সন্তানেব শখ যেন উকি মারিয়া যায়, একা থাকিবার সময় অবাক হইযা শ্যামা হাসে, কী কাণ্ড মেয়েমানুষেব, মাগো! বিধান দশটার সময় ভাত খাইয়া জুতা মোজা হাফপ্যান্ট আর শার্ট পরিয়া স্কুলে যায়, শ্যামা তাহার চুল আঁচড়াইয়া দেয়, আঁচল দিয়া মুখ মুছিয়া দেয়,--প্রথম প্রথম ছেলের মুখ সে একটু পাউডার মাখাইয়াও দিত, বডোলোকোব ছেলেদের মাঝখানে গিয়া বসিবে একটু পাউডার না মাখিলে কি চলে? স্কুলে ছেলেরা ঠাট্টা করা যা বিধান এখন আর পাউডার মাখাইতে দেয় না। বলে, তুমি কিছু জানো না মা, পাউডার দেখলে ওবা সবাই হাসে, সারা সুদ্ধ। কী বলে জান ?—বলে চুন তো মেখেই এসেছিস এবার একটু কালি মাখ, বেশ মানাবে তোকে, মাইরি ভাই, মাইরি। মাইবি বলে গ বিধানেব স্কুলে বডোলোকের সোনার চাদ অভিজাত ছেলেদেব মুখে এই কথাটির উচ্চারণ শ্যামার বড়ো খাপছাড়া মনে হয়। এমনই কত কথা বিধান শিখিয়া আসে, মাইরির চেয়েও ঢের বেশি খাবাপ কথা। অনেক বড়ো বড়ো শব্দও সে শিখিয়া আসে, আর সংকেত, শ্যামা যাব মানেও বুঝিতে পাবে না। তাহার অজানা এক জগতের সঙ্গে বিধান পরিচিত হইতেছে, অল্প-অল্প একটু যা আভাস পায় তাতেই শ্যামা অবাক হইয়া থাকে। সে একটা বিচিত্র গর্ব ও দুঃখ বোধ কলে। বাডিতে এখন বিধানেবা জিজ্ঞাসা কমিয়া গিয়াছে, প্রশ্নে প্রশ্নে আর সে শ্যামাকে ব্যতিব্যস্ত কবিয়া-তোলে না। ছাদে উঠিযা, খানিকদূরে বাঁধের উপর দিয়া যে রেলগাড়ি চলিয়া যায়, ছেলেকে তাহা দেখানোবা সাধ শ্যামার কিন্তু কমে নাই, জ্ঞান ও বুদ্ধিতে ছেলে তাহাকে ছাড়াইয়া যাইতেছে বলিয়া গৰ্ব্ব ও আনন্দের সঙ্গে শ্যামাব দুঃখ এইটুকু। বকুল আছে। সে কিন্তু মেযে। ছেলের মতো শ্যামার কাছে মেয়ের অত খাতির নাই। ছ। বছরের মেযে, সে তো বুড়ি । শ্যামা তাহাকে দিযা দুটি একটি সংসারের কাজ কাবায, মণিকে খেলা দিতে বলে, সময পাইলে প্রথম ভাগ খুলিয়া একটু একটু পড়ায়। মেয়েটা যেমন দুরন্ত হইয়াছে, সে রকম মাথা নাই, কিছু শিখিতে পারে না। তাহাকে অক্ষর চিনাইতেই শ্যামার একমাস সময় লাগিয়াছে, কতদিন কর খল শিখিবে কে জানে। মাঝে মাঝে রাগ করিয়া শ্যামা মেয়েব পিঠে একটা চড় বসাইয়া দেয়। বিধানও মারে। প্ৰথম ভাগের পড়া যে শিখিতে পারে না তার প্রতি বিধানের অবজ্ঞা অসীম। এক একদিন সকালবেলা হঠাৎ সে তাহার ক্লাস-মাস্টার অমূল্যবাবুর মতো গভীর মুখ করিয়া কুকুম দেয়, এই বুকু, নিয়ে আয় তো বই তোব,--বুকু ভয়ে ভয়ে বই লইয়া আসে, তাহার ছেড়া ময়লা প্রথম ভাগখানি। ভয় পাইলে বোঝা যায় কী বড়ো বড়ো আশ্চর্য দুটি চোখ বকুলের। পড়া ধরিয়া বোনের অজ্ঞতায় বিধান খানিকক্ষণ শ্যামার সঙ্গে হাসাহাসি করে, তারপর কখন যে সে অমূল্যবাবুর মতো ধা করিয়া চাটি মারিয়া বসে আগে কাবও টের পাইবার জো থাকে না। শ্যামা শুধু বলে, আহা খোকা, মারিস নে বাবা। বকুল বড়ো অভিমানী মেয়ে, কারও সামনে সে কখনও কঁদে না ; ছাদে চিলেকুঠির দেয়াল আর আলিসার মাঝখানে তাহার একটি হাতখানেক ফঁােক গোসাগর আছে, সেইখানে নিজেকে গুজিয়া দিয়া সে কঁাদে। তারপর গোসাঘরখানাকে পুতুলের ঘর বানাইয়া সে খেলা করে। যে পুতুলটি তাহার ছেলের