পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জননী 8Գ শ্যামা বলে, শীতল শোনে। শ্যামাকে বোধ হয় সে আর একজনের সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখে, যে এমনি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলিয়া বুঝাইয়া টাকা আদায় করিত, বলিত, আমায় দুখানা গয়না গড়িয়ে দে- টাকাটা তাহলে আটকা থাকবে, নইলে তুই তো সব খরচ করে ফেলবি!—দরকারের সময় তুই তোর গয়না বেচে নিস, আমি যদি একটি কথা কই--- সে এ সব বলিত মদের মুখে। শ্যামা কী? তারপব শ্যামা বলে, এ কাপড় তো পরতে পারব না। আমি ছেলের সামনে,-ও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে, আমাৰ লজ্জা করবে বাবু। না পরতে পার, ওই নর্দমা রয়েছে ওখানে ফেলে দাও।-শীতল বলে। রাত্রে ছেলেমেয়েরা সব ঘুমাইয়া পড়িলে শ্যামা আস্তে আস্তে শীতলকে ডাকে, বলে, হ্যাঁগা, ঘুমুলে নাকি? ফুটফুটে জোছনা উঠেছে দিব্যি, ছাতে যাবে একবারটি? শীতল বলে, আবােব ছাতে কী জন্যে?--কিন্তু সে বিছানা ছাড়িয়া ওঠে। শ্যামা বলে, গিয়ে একটা বিডি ধরাও, আমি আসছি। রঙিন কাপড়খানা পরিয়া শ্যামা ছাদে যায। বড়ো লজ্জা করে শ্যামার,-শীতলকে নয়, বিধানকে। ঘুম ভাঙিয়া রাত দুপুরে তার পরনে রঙিন কাপড় দেখিলে, ও যা ছেলে, ওর কী আর বুঝিতে বাকি থাকিলে শীতলের মন ভুলানোর জন্যে সে সাজগোজ করিয়াছে? অথচ শীতল শখ করিয়া কাপড়খানা আনিয়া দিয়াছে, একবার না পরিলেই বা চলিবে কেন ? শ্যামা মাদুর লইযা যায়, মাদুর পাতিয়া দুজনে বসে- চাঁদের আলোয় বসিয়া দুজনে দুটাে-একটা সাংসারিক কথা বলে, বেশি সময় থাকে চুপ করিয়া। বলার কী আর কথা আছে ছাই এ বয়সে! হ্যা, শীতল শ্যামাকে একটু আদর করে, শীতলের স্পর্শ আর, তেমন মোলায়েম নয়, কখনও যেন স্ত্রীলোকের সঙ্গ পায় নাই এমনই আনাড়ির মতো আদর করে। শ্যামা দোষ দিবে কাকে? সে ও তো কম মোটা হয় নাই! তাবপর একদিন শ্যামা সলজ্জভাবে বলে, কী কাণ্ড হয়েছে জান? শীতল শুনিয়া বলে, বটে নাকি! শ্যামা বলে, হ্যাঁ গো, চোখ নেই তোমার?——কী হবে বল তো এবার, ছেলে না মেয়ে? মেয়ে। উহুঁ, ছেলে।-- বুকু বেঁচে থাক, আমার আর মেয়েতে কাজ নেই বাবু। বলিয়া শ্যামা হাসে। মধুর পরিপূর্ণ হাসি, দেখিয়া কে বলিবে শীতলের মতো অপদাৰ্থ মানুষ তাহার মুখে এ হাসি জোগাইয়াছে।


চার

মাঝখানে একটা শীত চলিয়া গেল, পরের শীতের গোড়ার দিকে, শ্যামার নূতন ছেলেটির বয়স যখন প্রায় আটমাস, হঠাৎ একদিন সকালবেলা মামা আসিয়া হাজির। শ্যামার সেই পলাতক মামা তারাশঙ্কর। ছােটােখাটাে বেঁটে লোকটা, হাত-পা মোটা, প্রকাণ্ড চওড়া বুক। একদিন ভয়ংকর বলবান ছিল, এখন মাংসপেশিগুলি শিথিল হইয়া আসিয়াছে। শেষবার শ্যামা যখন তাহাকে দেখিয়াছিল মাথার চুলে তাহার পাক ধরে নাই, এবার দেখা গেল প্রায় সব চুল পাকিয়া গিয়াছে। সে তো আজকের কথা নয়। শ্যামার বিবাহের কিছুদিন পরে জমিজমা বেচিয়া গ্রামের সব চেয়ে বনেদি ঘরের বিধবা মেয়েটিকে