পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOOkS. in পুতুলনাচের ইতিকথা 8Գ (; কী ব্যাকুল, উৎসুক আবেদনের মতো শোনায় শশীর কথাগুলি। কে জানিত কুসুমকে তাহার এমন করিয়া একদিন বলিতে হইবে। শুনিতে শুনিতে বিস্ময়ের সীমা থাকে না কুসুমেব। শরীরটা যে শশীর ভালো নাই তার মুখ দেখিয়াই তা বোঝা যায়, হয়তো কুসুম মনে করে যে তাঁর এই সকাতর দুর্বলতা সেই জন্যই। সে মৃদুস্বরে বলিল, এ কী বলছেন ছোটােবাবু? আমার জন্যে আপনার মন কঁদবে ? শশী সরলভাবে বলিল, ভয়ানক মন কঁদবে বউ। জীবনে আমি কখনও তাহলে সুখী হতে পারব না । কুসুম ব্যাকুলভাবে বলিল, তা কি কখনও হয়? আপনার কাছে আমি কত তুচ্ছ, আমার জন্য জীবনে কখনও সুখী হতে পারবেন না! দুদিন পরে মনেও পড়বে না। আমাকে। শশী বলিল, এতকাল ধরে জড়িয়ে জড়িযে বেঁধেছি আর দুদিনে তোমাকে ভুলে যাব, তাই ভেবে নিলে তুমি ? শেষ পর্যন্ত কুসুম বলিল, আমার সাধি কী ছোটােবাবু আপনাকে জড়িয়ে জড়িয়ে বঁধব ? শশী ক্ষুব্ধ হইয়া বলিল, আজ ও সব বিনয় রাখো বউ। আজেবাজে বকার ধৈর্য আমার নেই। আমার কী হবে না হবে সে কথাও না। স্পষ্ট করে আমায় শুধু তুমি বুঝিয়ে দাও, চিরকাল আমার জন্যে ঘর ছাড়তে তুমি পাগল ছিলে আজকে হঠাৎ বিরূপ হলে কেন? এ সর্ব কথায্য কলহ হয় ছোটােবাবু। যাবার আগে কলহ কি ভালো ? কলহ হবে না, বলে। কুসুম স্নান মুখে বলিল, আপনাকে কী বলব ছোটােবাবু, আপনি এত বোঝেন! লাল টকটকে করে তােতানো লোহা ফেলে বাখলে তাও আস্তে আস্তে ঠান্ডা হযো যায়, যায় না ? সাধ আহাদ আমার কিছু নেই, নিজের জন্যে কোনো সুখ চাই না। বাকি জীবনটা ভাত বেঁধে ঘরের লোকোব সেবা করে কাটিয়ে দেব ভেবেছি।--আর কোনো আশা নেই, ইচ্ছে নেই! সব ভেঁাতা হয়ে গেছে ছোটােবাবু। লোকের মুখে মন ভেঙে যাবার কথা শূনতাম, অ্যাদিনে বুঝতে পেরেছি। সেটা কী। কাকে ডাকছেন ছোটােবাবু, কে যাবে আপনার সঙ্গে? কুসুম কি বেঁচে আছে? সে মরে গেছে। কুসুম মরিয়া গিয়াছে। সেই চপল বহস্যময়ী, আধোবালিকা আধোরমণী, জীবনীশক্তিতে ভবপুর, অদম্য অধ্যবসায়ী কুসুম। শশী যে কেন আর কোনো কথা বলিল না তার কারণটা দুর্বোধ্য। বোধ হয় ভাবিবার অবসর পাইবােব জন্য। কুসুম তো আজ ও কাল এখানে আছে। বলিবার কিছু আছে কিনা সেটাই আগে ভাবিয়া দেখা দরকার। মিনিটখানেক চুপচাপ দাঁড়াইয়া থাকিবার পর বাড়ির দিকে চলিতে আরম্ভ করিবাব সময় কুসুম শুধু বলিল, আপনি দেবতার মতো ছােটােবাবু। বাড়ি ফিরিয়া শশী বুঝিতে পারে কল্পনার এমন কতগুলি স্তর আছে বিশেষ কোনো উপলক্ষ ছাড়া যেখানে উঠিবার ক্ষমতা মানুষের নাই। এক একটা ঘটনা যেন চাবির মতো মনেৰ এক একটা দুয়ার খুলিয়া দেয়, যে দুয়ার ছিল বলিয়াও মানুষ জানিত না। এত বড়ো বড়ো কল্পনা শশীর, এত বিবাট ও ব্যাপক সব মনোবাসনা, একদিনে সব যেন পৃথক অনাবশ্যক হইয়া গেল,-শিশুর মনের বড়ো বড়ো ইচ্ছাগুলি যৌবনে যেমন যায়। রবার বসানো চাকা-যুক্ত গদিআটা ঠেলা গাড়িতে চাপার জন্য ছেলেবেলা কত কঁাদিয়াছিল শশী, কলিকাতায় মোটর হাঁকাইবার সাধ আজ তারই পর্যায়ে গিয়া পড়িয়াছে। গ্রাম ছাড়িয়া কোথায় যাইবে শশী ? কী আছে গ্রামের বাইরে শশীর যা মনোহরণ করিতে পরিবে? একটা প্রকাণ্ড জড় পৃথিবী, অসংখ্য অচেনা মানুষ। কী পাইবে শশী সেখানে ? কুসুমের কথাগুলির অন্তরালে যত অর্থ ছিল ক্ৰমে ক্ৰমে শশী তা পরিষ্কার বুঝিতে পারে। একদিন দুদিন নয়, অনেকগুলি সুদীর্ঘ বৎসর ব্যাপিয়া তার জন্য কুসুম পাগল হইয়া ছিল, তারপর ক্ৰমে ক্ৰমে