পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in 8tro মানিক রচনাসমগ্ৰ আশ্চর্য হইয়া গেল। বসন্ত যখন বুপ মুছিয়া লইয়া গেল সেনদিদির, তখন মমতা আসিল গোপালের, এমন গভীর অবুঝ স্নেহ! তারপর শশী বলিল, যান, শোবেন যান। আপনি। আমি যাচ্ছি ও বাড়ি জামাটা গায়ে দিয়ে। গোপাল নিবৃত্তবে উঠিয়া গেল। মুখ দিয়ে আর তাহার কথা বাহির করার মতো ক্ষমতা ছিল না। শশী তাহাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে, আজ যে কষ্ট দিল তার তুলনা হয় না। কৃপানাথ যখন ডাকিতে আসিয়াছিল তখন যদি শশী সেনদিদিকে দেখিতে যাইত, এ লজাটা তবে গোপালের থাকিতে পারিত নেপথ্যে । এ ভাবে যখন তাহাকে যাইতেই হইল, সেনদিদিকে বাঁচানোর চেষ্টাটা শশী বিশেষ সমারোহেব সঙেগই করিয়া দেখিল। রাতদুপুরে এই বিপদগ্ৰস্ত বাড়িতে সে আরও একটা অতিরিক্ত বিপর্যয় আনিয়া ফেলিল। হুকুম দিয়া ধমক দিয়া সকলকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল। অনেক জল গরম হইল, লোক পাঠাইয়া হাসপাতাল হইতে ওষুধ যন্ত্রপাতি ও কম্পাউন্ডারকে আনানো হইল, দেখিয়া কে বলিবে কিছুক্ষণ আগেও উদাসীন শশী সেনদিদিকে মরিতে দিতে প্ৰস্তুত ছিল! আবার তেমনই জিদ, শশীর আসিয়াছে যার জোরে সেনদিদিকে আগে একবার সে বঁাচাইয়াছিল। সেদিন সে লড়িয়ছিল বাহিরের বাধার সঙ্গে, আজ কি শশীকে লড়িতে হইল অন্তরের বাধার সঙ্গে ? মুমূৰ্ম্ম সেনদিদিকে দেখিযাও কি শশীর মনের বিতৃষ্ণা মিলাইয়া গেল না ? সব তো তারই হাতে, এ দুজনের মরণ বাঁচান! কী না করিতে পারে শশী ? শুধু সেনদিদির নয়, সেনদিদির এই নবাগত চিহ্নের চিহ্নকেও তো সে চিরদিনের জন্য পৃথিবী হইতে মুছিয়া দিতে পারে। কারও প্রশ্ন করাও চলিবে না কেন এমন হইল। শশী কি শুধু মানুষ বঁাচাইতে শিখিয়াছে, মারিতে শেখে নাই ? অতি সহজে, অন্যমনস্ক অবস্থায ভুল কবার মতো করিয়াও, সে তা পারে। বাকি জীবনটা তাতে খুব কি আপশোশ করিতে হইবে শশীকে ? শেষ রাত্রে একটি ছেলে হইল সেনদিদির, ভোরবেলা সেনদিদি মরিয়া গেল। এত কম জীবনীশক্তি ছিল সেনদিদির, এত দুর্বল হইয়া গিয়াছিল তার কুৎপিণ্ড যে প্রথমে তাকে পবীক্ষা করিয়া শশীর বিশ্বাস হইতে চাহে নাই, সেনদিদিকে দেখিয়া কখনও মনে হয় নাই তার দেহ যন্ত্রের আসল ইঞ্জিনটা এমন হইয়া গিয়াছে। তবু, শশীও ভাবিতে পারে নাই এ যাত্রা সে রক্ষা পাইবে না। ডাক্তার মানুষ সে, সেও যে ভালো করি যা বুঝিতে পারিল না অজ্ঞান অবস্থা পার হইয়া সেনদিদির যখন শান্ত হইয়া ঘুমাই৩ে আরম্ভ করা উচিত ছিল। হঠাৎ হাত পা কেন ঠান্ড হইয়া আসিল। শশী জানে এ রকম হয়, মানুষের দেহের মধ্যে আজও এমন কিছু ঘটিয়া চলে এ যুগের ধন্বন্তরিরও যা থাকে জ্ঞানবুদ্ধির অগোচর। এ তো মানুষের বানানো কল নয়। তবু শশীর রাতজাগা চোখের আরক্ত ভাব যেন বাড়িয়া গেল, অবসাদ যেন হইয়া উঠিল। অসহ্য। আর কিছু করিবার ছিল না, বাড়ি গিয়া স্নান করিয়া শশী কডা এককাপ চা খাইল, তারপর শূইয়া পড়িল। আসিবার সময় ও বাড়ির বাহিরে গোপালকে সে দেখিয়া আসিয়াছে। চেনা ও জানা মানুষগুলির মধ্যে দু-চারজনকে শশী যেমন মরিতে দেখিয়াছে, তেমনই তাদের ঘরে দু-চারজনকে জন্ম লইতেও দেখিয়াছে; দু-চারজন মরিবে দু-চারজন জন্ম লইবে এই তো পৃথিবীর নিয়ম। তবু এ সব মরণ মরণে অভ্যস্ত শশী ডাক্তারকে বড়ো বিচলিত করে। যারা মরে তারা চেনা, স্নেহ ও বিদ্বেষের দীর্ঘকালব্যাপী সম্পর্ক তাদের সঙ্গে, যারা জন্মায় তারা তো অপরিচিত। এই কথা ভাবে শশী : সেনদিদি কি বাঁচিত, সে যদি অন্যভাবে চেষ্টা করিত, যদি অন্য ওষুধ দিত ? শেষের দিকে সে যে ব্যস্তভাবে গোটা দুই ইনজেকশন দিয়াছিল রোগিণীর পক্ষে তা কি অতিরিক্ত জোরালো হইয়াছিল ? হইয়া থাকিলেও তার দোষ কী? অনেক বিবেচনা করিয়া। তবে সে ইনজেকশন দুটো দিয়াছিল, তা ছাড়া আর কিছুই তখন করিবার ছিল না। নিজের জ্ঞানবুদ্ধিতে যা ভালো বুঝিয়াছে