পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in 8brS মানিক রচনাসমগ্ৰ একটু ঈৰ্ষাপ্রবণও বটে, শাড়ি-গহনার লোভটাও বেশ একটু প্রবল, স্বামী তার গোপালের মুহুরিদের সঙ্গে মিশ খাইয়া গিয়াছে, তবু কুন্দ এত সুখী যে শখ করিয়া দুটাে-একটা কৃত্রিম দুঃখ বানাইয়া সে উপভোগ করে, তার অভাব-অভিযোগগুলিও তাই। কুন্দর অস্তিত্ব এতকাল শশীর কাছে ছিল জড়বস্তুর মতো নিরর্থক, আজ ওর অর্থহীন জীবনে এমন সুখের সমাবেশ দেখিয়া সে যেন খানিকটা ভড়কাইয়া গেল। কী যেন করিয়া দিয়া গিয়াছে শশীকে কুসুম। সামনে আসিলেই মানুষের চোখে মুখে ব্যাকুল চোখে কী যেন শশী খোজে। মুখে হাস্যচ্ছটা দেখিলে, চোখে আনন্দের ছাপ দেখিলে শশীর মন জুড়াইয়া যায়। সজল চোখে ক্লিষ্ট কাতর মুখে যে দাঁড়ায় শশীর সামনে তাকে শশীর মারিতে ইচ্ছা হয়। হঠাৎ কুন্দকে বড়ো ভালো লাগে শশীর। সস্নেহে বলে, তোর কী চাই বল তো কুন্দ? খুব ভালো একখানা কাপড় নিবি? বেনারসি ? কুন্দ অবাক। বলে, হঠাৎ কাপড় কেন দাদা ? শশী গভীর মুখে বলে, দেব, তোকে একখানা কাপড় দেব। এমনি দেব কুন্দ, মিছিমিছি। মিছিমিছ কুন্দকে শশী কাপড় কিনিয়া দেয়, এদিকে আবির্ভাব ঘটে গোপালের গুরুদেবের। ভোলা ব্ৰহ্মচারী নামে তাঁর খ্যাতি। সুপুষ্ট লোমশ দেহ, মাথা গোফদাড়ি ভ্ৰ সব কামানো, হাতে কুচকুচে কালো একটি দণ্ড, গায়ে গেরুয়া, পায়ে গেরুয়া রং করা রবার সোলের ক্যাম্বিস জুতো। বছর পাঁচেক একে গোপাল একরকম ভুলিয়াই ছিল, হঠাৎ এমন ব্যাকুলভাবে স্মরণ করিয়াছে যে ভগবানকে করিলে হয়তো তিনিও দেখা দিতেন। সসম্মানে সাষ্টাঙ্গ প্ৰণাম করিল গোপাল, স্বহস্তে পা ধোয়াইয়া দিল । অন্দরের একখানা ঘর আগেই ধুইয়া মুছিয়া পরিষ্কার করিয়া রাখা হইয়াছিল, সেখানে ভোলা ব্ৰহ্মচারীকে থাকিতে দেওয়া হইল। ব্ৰহ্মচারীকে শশী ভক্তি করিত, এ সময় হঠাৎ তাহার আগমনে বিশেষ খুশি না হইলেও শ্রদ্ধার সঙ্গে একটা প্ৰণাম করিল। ব্ৰহ্মচারী দিন সাতেক রহিয়া গেলেন। এই সাতদিন এক মুহূর্তের জন্য গোপাল তাহার সঙ্গ ছাড়িল না। কত প্রশ্ন গোপালের, কত ব্যাকুল নিবেদন! গোপালের অবহেলায়-বাজিতপুরের কোর্টে একটা মামলা ফাসিয়া গেল। তা যাক, মনে বৈরাগ্য আসিয়াছে, ও সব মামলা মকদ্দমা বিষয়কর্ম তার কাছে এখন তুচ্ছ। শুধু সেনদিদির জন্য তো নয়, আজ কতকাল হইল গোপালের মনে ভাবনা ঢুকিয়াছে, কীসের জন্য এ সব! কার জন্য সে এতকষ্টে অর্থসম্পদ সংগ্ৰহ করিতেছে! একটা মেযে আছে সিন্ধু, দুদিন পরে ওর বিবাহ দিলে পরের ঘরে চলিয়া যাইবে, তখন কে থাকিবে গোপালের ? শশী? শশীর কাছে কোনো আশা ভরসাই সে রাখে না। বােপকে যে ছেলে ঘূণা করে, তার কাছে কী প্ৰত্যাশা থাকে বাপের ? ধরিতে গেলে সেই তো মনটা ভাঙিয়া দিয়াছে গোপালের । এ বড়ো আশ্চর্য কথা যে কুসুমের মতো গোপালের মনটাও শশীই ভাঙিয়া দিয়াছে! এ দুজনের মনের মতো হইতে না পারার অপরাধটা শশীর এতবড়ো! ভাঙা মনটা লইয়া কুসুম সরিয়া গিয়াছে। গোপাল আজও হাল ছাড়ে নাই। ব্ৰহ্মচারীর কাছে মনোবেদনা ব্যক্ত করিয়া সে তফাতে যায়, ব্ৰহ্মচারী ডাকেন। শশীকে। বাবা শশী, তুমি বিদ্বান বুদ্ধিমান, তোমাকে বলাই বাহুল্য যে খেয়ালের চেয়ে কর্তব্য অনেক বড়ো। আঞ্জে হ্যা। বােপকে ভক্তিশ্রদ্ধা করার চেয়ে বড়ো কর্তব্য ছেলের আর কী আছে? ঠিক এমনিভাবেই বলেন ব্রহ্মচারী, এমনই ভূমিকাবিহীন কঠোর ভাষায়। কথাটা তাই বড়ো জোরালো হয়। শশী আহত হইয়া বলে, বাপের প্রতি ওটাই ছেলের প্রথম কর্তব্য বইকী। ছেলের মনের ওটা স্বাভাবিক ধর্ম বাবা, যুক্তিতর্কে বোঝানোর জিনিস নয়। বাপের স্বভাব মন্দ হলে ছেলে