পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in 8 S SR মানিক রচনাসমগ্ৰ গোপাল সহজভাবেই বলিল, পরশু তোর যাওয়া হয় না। শশী, আমি আজ বাবার কাছে কাশী যাচ্ছি--সাত আটদিন আশ্রমে থাকব। একজনের বাড়ি না থাকলে চলবে না। আমি ফিরে এলে যা হয় করিস। শশী বলিল, হঠাৎ কাশী যাবেন কেন ? গোপাল পালটা জবাব দিয়া বলিল, হঁ্যারে শশী, চিবকাল সংসারের হাঙগামা নিয়ে হয়রান হয়ে এলাম, এখন তোরা বড়ো হয়েছিস, মনটন ব্যাকুল হলে সাতটা দিনের ছুটিও পাব না? এতটুকু আশাও তোদের কাছে আমার করা চলবে না ? শশী মৃদুস্বরে বলিল, তা বলিনি, কোথাও কিছু নেই হঠাৎ যাচ্ছেন, তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম। কালও তো কিছু বলেননি। আমাকে ? গোপাল দারুণ অভিমান করিয়া বলিল, না। যদি থাকতে পারিস তো বল, যাওয়া বন্ধ কবি। আদেষ্টের লেখা কে খণ্ডাবে। শশী বলিল, বেশ তো আসুন গিয়ে—কদিন পরে গেলেও আমার কোনো অসুবিধা হবে না। গোপালকে শশী প্ৰণাম করিল। সকাল বেলার স্বচ্ছ আলোয় দুজনের মুখ দেখিয়া মনে হইল না। পিতাপুত্রে কোনোদিন কোনো সামান্য বিষয়েও মতান্তর ছিল, জীবনের গতি দুজনের বিপবীতগামী। সেই যে গেল গোপাল আর সে ফিরিল না। সংসারী গৃহস্থ মানুষ সে, সমস্ত জীবন ধরিয়া ফল পুষ্প৷ শস্যদাত্রী ভূমিখণ্ড, সিন্দুক ভরা সোনা রুপা, কতকগুলি মানুষের সঙ্গে পারিবারিক ও আরও কতগুলি মানুষের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক, দায়িত্ব, বাধ্য-বাধকতা প্রভৃতি যত কিছু অর্জন করিয়াছিল সব সে দিয়া গেল। শশীকে, মরিয়া গেলে যেমন সে দিত। কুন্দ কয়েকদিন পরে ফিরিয়া আসিল। রাজাতলা হইয়া গোপাল সেনদিদির ছেলেকে সঙ্গে লইযা গিয়াছে। কুন্দ সোনাব হার কিনিবে বলিয়া দুশো টাকাও তাহাকে দিয়া গিয়াছে হয়তো। ওটাই ছিল গোপালের শেষ বাধ্যবাধকতা। কী আর করিলে শশী, এ ভার তো ফেলিবার নয়। গভীর বিষন্ন মুখে একে একে যাওয়ার আয়োজনগুলি সে বাতিল করিয়া দিল। দুমাসের মাহিনী পকেটে পুরিয়া অমূল্য ফিরিয়া গেল, গাঁযে থাকিতে হইলে হাসপাতালে প্রত্যেক রোগীর নাড়ি টিপিতে না পারিলে শশীর চলিবে কেন ? কাজ আর দায়িত্ব ছিল জীবনে, কাজ আর দায়িত্বে জীবনটা আবার ভরপুর হইয়া উঠিল। নদীর মতো নিজের খুশিতে গড়া পথে কি মানুষের জীবনের স্রোত বহিতে পারে? মানুষের হাতে কাটা খালে তার গতি, এক অজানা শক্তিব অনিবার্য ইঞ্জিগতে। মাধ্যাকর্ষণের মতো যা চিরন্তন, অপরিবর্তনীয়। মামলা করিতে শশী বাজিতপুরে যায়, ফিরিবার পথে চোখ তুলিয়া দেখিতে পায় খালের ধারে বজাহত একটা বটগাছ শুকনো ডালপালা মেলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। গাওদিয়ার ঘাটে গোবর্ধন নীেকা ভিড়ায়। নন্দলালের পট জমা করা শূন্য চালােটা প্রায় ভাঙিয়া পড়িয়াছে দেখিয়া শশীর মনে হয় নন্দলালের পাপ জমা করা বিন্দুর দেহটাও হয়তো এতদিনে এমনিভাবে ভাঙিয়া পড়িয়াছে। জোরে আর আজকাল শশী হাঁটে না, মন্থর পদে হাঁটিতে হাঁটিতে গ্রামে প্রবেশ করে। গাছপালা বাড়িঘর ডোবা পুকুর জড়াইয়া গ্রামের সর্বাঙ্গ-সম্পূর্ণরূপের দিকে নয়, শশীর চােখ খুজিয়া বেড়ায় মানুষ। যারা আছে তাদের, আর যারা ছিল। শ্ৰীনাথের দোকানের সামনে, বঁধানো বকুলতলায়, কায়েতপাড়ার পথে। যামিনী কবিরাজের বাহিরের ঘরে হামানদিস্তার ঠকঠক শব্দ শশী আজও শুনিতে পায়, এ বাড়ির মানুষের ফঁােক মানুষ পূর্ণ করিয়াছে। যাদবের বাড়িটা শুধু গ্ৰাস করিতেছে জঙ্গলে, পরানের বাড়িতেও এখনও লোক আসে নাই। তার ও পাশে তালবন। তালবনে শশী কখনও যায় না। মাটির টিলাটির উপরে উঠিয়া সূর্যস্ত দেখিবার শখ এ জীবনে আর একবারও শশীর আসিবে না।