পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in জননী VS মামা বলিল, আমায় কেন সন্দেহ করবে?--আসিব শ্যামা, মাঝে মাঝে আমি আসব। রাত্ৰি প্ৰভাত হইল, শ্যামার ঘরের ছাদ পিটানোর শব্দে দিনটা মুখর হইয়া রহিল, দুদিন দুরাত্রি গেল পাব হইয়া, না আসিল পুলিশ, না আসিল মামা, না আসিল শীতল। শ্যামার চোখে জল পুরিয়া আসিতে লাগিল। কতকাল আগে তাহার বারো দিনের ছেলেটি মরিয়া গিয়াছিল তাব।পর আর তো কোনোদিন সে ভয়ংকর দুঃখ পায় নাই, ছোটােখাটাে দুঃখদুর্দশা যা আসিয়াছে স্মৃতিতে এতটুকু দাগ পর্যন্ত বাখিয়া যায় নাই, সুখ ও আনন্দেব মধ্যে কোথায় মিশাইয়া গিয়াছে। জীবনে তাহার গতি ছিল, কোলাহল ছিল, আজ কী স্তব্ধতার মধ্যে সেই গতি বুদ্ধ হইয়া গেল দ্যাখে। শ্যামা বসিয়া বসিয়া ভাবে। বকুল ? কোথায্য কী অবস্থায্য মেয়েটা কী করিতেছে কে জানে! শীতলের সঙ্গে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেডায়, সময়ে হয়তো খাইতে পায় না, নরম বালিশ ছাড়া মেয়ে তাহাব মাথায় দিতে পারিত না, কোথায • কীভাবে পড়িয়া হয়তো এখন সে ঘুমায়, শীতল হয়তো বকে, চুপিচুপি অভিমানিনী লুকাইয়া কঁদে ? বিষ্ণুপ্রিযর মেযেব দেখাদেখি বকুলের কত বাবুয়ানি ছিল, ময়লা ফ্রকটি গায়ে দিত না, মুখে সর মাখিত, লাল ফিতা দিয়া তাহার চুল র্বাধিয়া দিতে হইত, আঁচলে এক ফোটা অগুরু দিবােব জন্য মার পিছনে পিছনে আবদার করিয়া ঘুরিত। কে এখন জামায তাহার সাবান দিযা দেয় ? কে চুলেব বিনুনি করে ? বকুলেব মুখে কত ধুলা না জানি লাগে, আঁচল দিয়া সে শুধু মুখটি মুছিয়া ফেলে, কে দিবে তা শহ:", "স্ফদা, কে দিবে দুধেব সব। দিন তিনেক পরে মামা আসিল। বলিল, সার্চ করে গেছে? করেনি ? ব্যাপার। তবে কিছু বোঝা গেল না। শ্যামা, কী মতলব যেন করেছে কমলবাবু, আঁচ কবে উঠতে পারছি না। শ্যামা বলিল, টাকাটাব কোনো ব্যবস্থা করে তুমি এসে থাকতে পার না মামা এখানে ? এই পুলিশ আসে, এই পুলিশ আসে। কবে ভয়েভযে থাকি, এ.স তারা কী করবে। কী বলবে কে জানে, মারধোব করে যদি, জিনিসপত্র যদি নিয়ে চলে যায় ? মামা একগাল হাসিযা বলিল, থাকিব বলেই তো টাকার ব্যবস্থা করে এলাম রে । কোথাযথ রেখেছি ? তুই চিনবিনে, মস্ত জমিদার। নতুন কাপড়েল পুলিন্দে করে সি-সমাহব এঁটে জমা দিয়েছি, বলেছি গাযে আমার বাড়ি ঘর আছে না, তার দলিলপত্র,-ঘুরেঘুরে বেড়াই হাবিয়ে-টারিয়ে ফেলব, তোমাব সিন্দুকে যদি বেখে দাও বাবা ? বড়ো ভক্তি কবে আমায়, বলে, যোগতপস্যা সব ছেড়ে দিলেন। নইলে আপনি তো মহাপুরুষ ছিলেন, দীক্ষা নেব ভেবেছিলাম আপনার কাছে।.জানিস মা, পিঠের ব্যথাটা আবাব চাগিয়েছে, ব্যথায় কাল ঘুম হযনি। রাণী একটু মালিশ কবে দিক ?—শ্যামা বলিল। দশ বাবে দিন কাটিযা গেল। বিষ্ণুপ্রিযা একদিন শ্যামাকে ডাকিয়া পঠাইয়াছিল, রাগাবাগি করিয়া মেযে লইযা শীতল চলিয়া গিয়াছে এই পর্যন্ত শ্যামা তাহাকে বলিয়াছে, টাকাচুরির কথাটা উল্লেখ করে নাই। বিষ্ণুপ্রিয়া সমবেদনা দেখাইয়াছে খুব, বলিয়াছে, ভেবে ভেবে রোগা হয়ে গেলে যে, ভেবো না, ফিরে আসবে। বাড়িঘর ছেড়ে কদিন আর **াকবে পালিযে ? তারপ: ভাবিয়া-চিন্তিয়া বলিয়াছে, সংসার-খরচের টাকাকডি বেখে গেছে তো? শ্যামা জবাবে বলিয়াছে, কী কুক্ষণে যে দোতলায়। ঘরতোলা আরম্ভ করেছিলাম দিদি, যেখানে যা ছিল কুড়িয়ে পেতে সব ওতেই ঢেলেছি, কাল কুলি-মিস্ক্রির মজুরি দেব কী কবে ভগবান জানেন।-বলিয়া সজল চোখে সে নিশ্বাস ফেলিয়াছে। তারপর বিষ্ণুপ্রিয়া খানিকক্ষণ ভাবিয়াছে, ভু কুঁচকাইয়া একটু যেন বিরক্ত এবং রুষ্টও হইয়াছে, শেষে উঠিয়া গিয়া হাতের মুঠীয় কী যেন আনিয়া শ্যামার আঁচলে বাঁধিয়া দিয়াছে। কী লজ্জা তখন এ দুটি জননীব। চোখ তুলিয়া কেহ আর কারও মুখের দিকে চাহিতে পারে নাই।