পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in Mbr মানিক রচনাসমগ্ৰ বিধান অবজ্ঞাব সুরে বলিল, তুমি খালি ভাব!——আমার চেয়ে কত ছোটাে ছেলে একলা ট্রামে চেপে স্কুলে যায়। আমি যেখানে খুশি যেতে পারি মা,-যাইনি ভাবিছ? ট্রামে করে কদিন গেছি চিড়িয়াখানায় চলে। শ্যামা স্তম্ভিত হইয়া বলিল, স্কুল পালিয়ে একলাটি তুই চিড়িয়াখানায় যাস খোকা! বিধান বলিল, রোজ নাকি? একদিন দুদিন গেছি মোটে-স্কুল পালাইনি তো। প্রথম ঘণ্টা ক্লাস হয়ে কদিন আমাদের ছুটি হয়ে যায়, ক্লাসের একটা ছেলে মবে গেলে আমরা বুঝি স্কুল করি ? এমনি হইচই করি যে হেডমাস্টােব ছুটি দিয়ে দেয়। প্রথম প্রথম শীতলের জন্য বকুল কঁাদিত। দোতলার ঘরখানা শ্যামা তাহাদের শয়নকক্ষ কবিয়াছে, দামি জিনিসপত্রের ব্যাকসো-প্যাটরা, বাড়তি বাসন-কোসনও ওই ঘরে থাকে, সকালে বিকালে ও ঘবে কেহ থাকে না, শুধু বকুল আপন মনে পুতুলখেলা করে। পুতুল খেলিতে খেলিতে বাবার জন্য নিঃশব্দে সে কঁাদিত, মনের মানুষকে না দেখাইয়া অতটুকু মেয়ের গোপন কান্না স্বাভাবিক নয, কী মন বকুলের কে জানে। কোনো কাজে উপরে গিয়া শ্যামা দেখিত মুখ বঁকাইয়া চোখের জলে ভাসিতে ভাসিতে বকুল তাহার পুতুল-পরিবারটিকে খাওয়াইতে বসাইয়াছে। মেয়ে কার জন্য কঁদে শ্যামা বুঝিতে পারিত, এ বাড়িতে সেই জেলের কয়েদিটাকে ও ছাড়া আর তো কেহ কোনোদিন ভালোবাসে নাই । মেয়েকে ভুলাইতে গিয়া শ্যামারও কান্না আসিত। মেয়েকে কোলে করিয়া পুরানো বাডির ছাদে নুতন ঘরে ঝকঝকে দেয়ালে ঠেস দিয়া শ্যামা বসিত, বুজিত চোখ। শ্যামাব কি শ্ৰান্তি আসিয়াছে? আগের চেয়ে খাটুনি এখন কত কম, তাই সম্পন্ন করিতে সে কি অবসন্ন হইয়া পড়ে? যাওয়াটা অভ্যাস হইয়া আসিতে আসিতে শহরতলি যেন বসন্তের সাড়া পাইয়াছে। ধানকলের চোঙাটাব। কুণ্ডলী-পাকানো ধোঁয়া উত্তরে উড়িয়া যায়, মধ্যাহ্নে যে মৃদু উষ্ণতা অনুভূত হয় তাহা যেন যৌবনের স্মৃতি। শ্যামার কি কোনোদিন যৌবন ছিল ? কী করিয়া সে চারটি সন্তানের জননী হইয়াছে, শ্যামার তো তা মনে নাই! আজি সে দারুণ বিপন্ন, স্বামী তার জেল খাটিতেছে, উপাৰ্জনশীল পুরুষেব আশ্রয় তাহার নাই, ভবিষ্যৎ তাহার অন্ধকার, শাহবতলিতে বন-উপবনের বসন্ত আসিলেও জীবনে কবে তাহাব যৌবন ছিল তা কি শ্যামার মনে পড়া উচিত ? কী অবাস্তর তার বর্তমান জীবনে এই বিচিত্র চিন্তা ? মুমূর্য্যর কাছে যে নামকীর্তন হয়। এ যেন তারই মধ্যে সুব-তাল-লব্য মান খুজিয়া বেড়ানো। জেলের কয়েদি বাপের জন্য যে মেয়ের চোখে জল তাকে কোলে করিয়া স্বামীব বিরহে সকতর হওয়া কর্তব্য কাজ, কিন্তু জননী শ্যামা, তুমি আবার ছেলে চাও শুনিলে দেবতার হাসিবেন যে, মানুষ যে ছিছি করিবে । মামা বলে, এইবাৰ উপার্জনের চেষ্টা শুরু করি শ্যামা, কী বলিস ? শ্যামা বলে, কী চেষ্টা করবে ? মামা রহস্যময় হাসি হাসিয়া বলে, দ্যাখ না। কী করি। কলকাতায় উপার্জনের ভাবনা! পথেঘাটে পয়সা ছড়ানো আছে, কুড়িয়ে নিলেই হল। একটা দুটাে করে নোটগুলো বদলানো আরম্ভ করলে হয় না ? তুই ভারী ব্যস্তবাগীশ শ্যামা ! থাক না, নোট কি পালাচ্ছে ? সংসার তোর অচলও তো হয়নি বাবু এখনও ! হয়নি, হতে আর দেরি কত ? সে যখন হবে, দেখা যাবে তখন,-“এখন থেকে ভেবে মরিস কেন?