পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in 8 মানিক রচনাসমগ্র বিধানের কলিকাতার খরচ, মণি স্কুলে যাইতেছে তার খরচ, শীতলের জন্য খরচ, অসুখবিসুখের খরচ,--শ্যামার তো মনে হইত মন্দার নয়, খরচ খরচ খরচ, চারিদিকে শুধু খরচ, তার। আর বকুল ? বকুলের জন্য শ্যামার খরচ হয় নাই ? হাজারের যা অবশিষ্ট ছিল, বকুল একাই প্ৰায় তা শেষ করিয়া দিয়াছে। বকুলের বিবাহ হইয়াছে, আমাদের সেই বকুলের ? কার সঙ্গে বিবাহ হইয়াছে বকুলের, শঙ্করের সঙ্গে নাকি? পাগল! শঙ্করের সঙ্গে বকুলের বিবাহ হয় না। ...A যে বৈশাখে আমাদের বকুলের বিবাহ হইল, তাহার আগের ফাঙ্গুনে বিবাহ হইযাছিল সুপ্রভার মেয়েটির, বিবাহের তিন-চার দিন আগে কলিকাতা হইতে বিধানের সঙ্গে শঙ্করও আসিয়াছিল। বয়সের আন্দাজে বকুল মস্ত হইয়া উঠিয়াছিল, শঙ্কর ভাবিতে পারে নাই বকুল এতবড়ো হইয়াছে, আর এত লজ্জা হইয়াছে বকুলের, আর এত সুন্দর হইয়াছে সে। মেয়ের সম্বন্ধে শ্যামা যে এত সাবধান হইয়াছে তাও কি শঙ্কর জানিত ? বিবাহের পরদিন দুপুরবেলা বকুলকে আর শ্যামা দেখিতে পায। না। কোথায় গেল বকুল ? বাড়িতে পুরুষ গিজগিজ করিতেছে, যেখানে যেখানে মেয়েরা একত্র হইয়াছে বকুল তো সেখানে নাই ? হাতের কাজ ফেলিয়া রাখিয়া শ্যামা এখানে খোজে। ওখানে খোজে, একে তাকে জিজ্ঞাসা করে। একজন বলিল, এই তো দেখলাম। এখানে খানিক আগে, দ্যাখ না কলাবাগানে গেছে নাকি ? বাড়ি পিছনে কলাবাগান, কলাবাগানে সেই টেকিঘর। তাই বটে, টেকিঘর টেকিটার উপর বসিয়া শঙ্কর আব্ব বকুল কথা বলিতেছে বটে। ঘরের কোণে এখানে বকুল আর এখন পুতুলখেলা করে না, খেলাঘর তার ভাঙিয়া গেছে, শুধু আছে চিহ্ন, কতবার ঘর লেপা হইয়াছে আজও চারিদিকে উচু আলের চিহ্ন, পুকুরের গর্ত, উনানের গর্ত মিলাইয়া যায় নাই, বেড়ায় যে শিউলিবেঁটার বঙে ছােপানাে ন্যাকডাটি গোঁজা আছে সে তো বকুলের পুতুলেরই জামা। পুতুলখেলার ঘবে কী ছেলেখেলা আজ করিতেছে বকুল ? একটু বাড়াবাড়ি রকম কাছাকাছি বসিয়া আছে ওরা, আর কিছু নয়। না, বকুলের হাতটিও শঙ্করের হাতে ধরা নাই। শ্যামা বলিয়াছিল, ও বকুল, এখানে বসে আছিস তুই ? মেয়েজামাই যাবে যে এখন, আয চলে আয। বকুল তো আসিল, কিন্তু মেয়ের মুখ রাঙা কেন, চোখ কেন ছিলোছালো ?--শঙ্কর আসিয়াছে চার-পাঁচদিন, সকলেব সামনে শঙ্কবোব সঙ্গে কত কথা বকুল বলিয়াছে, দুচার মিনিট একা কথা বলিবার সময়ও কতবার শ্যামা হঠাৎ আসিয়া ওদের দেখিয়াছে, শ্যামাকে দেখিয়াও কথা শঙ্কর বন্ধ করে নাই, বকুল হাসি থামায় নাই। টেকিঘরে আজ ওরা কোন নিষিদ্ধ বাণীর আদান-প্ৰদান করিতেছিল, বকুলের মুখে যা রং আনিয়াছে, চোখে আনিয়াছে জল ? কী বলিতেছিল শঙ্কর বকুলকে ? শ্যামা একবার ভাবিয়াছিল বকুলকে জিজ্ঞাসা করিবে। শেষে কিছু না বলাই ভালো মনে করিয়াছিল। কিছুই হয়তো নয়। হয়তো নির্জন ঢেঁকিগরে শঙ্করের কাছে বসিয়া থাকার জন্যই বকুল লজ্জা পাইয়াছিল, ওখানে ও ভাবে বসিয়া থাকা যে তার উচিত হয় নাই বকুল কি আর তা বোঝে না। তারপর যে কদিন শঙ্কব। এখানে ছিল, আর তিনটি দিন মাত্র, বকুলকে শ্যামা একাদণ্ডের জন্য চোখের আড়াল করে নাই। বকুল রাগ করিয়া বলিয়াছিল, সারাদিন পেছন-পেছন ঘুরছে কেন বলো তো ? বকুলের বোধ হয় অপমান বোধ হইয়াছিল। শ্যামা বলিয়াছিল, পেছন-পেছন আবার তোর ঘুরলাম, কখন? তারপর বকুল কঁদিয়া ফেলিয়াছিল, গিয়া বসিয়াছিল। শীতলের কাছে, সারাটা দিন।