পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র ষষ্ঠ খণ্ড.pdf/১৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SV)8 মানিক রচনাসমগ্ৰ তবে কথা এই যে, এটা মেশাল পাড়া। নিজেরাই বলাবলি করে নিজেদের মধ্যে যতটা নিরূপায় নয়। তার চেয়ে অনেক বেশি মরিয়ার মতো। এতেই অনেকটা ভরসা খাড়া আছে মারাত্মক আতঙ্ক গুজব আর উসকানির সোজাসুজি প্যাচালো আর চােৱাগোপ্ত আঘাত সয়ে, যে আঘাত চলছেই। বাস্তব একটা অবলম্বনও পাওয়া গেছে সকলে মিলে গড়া পিস-কমিটিতে, বিভ্ৰান্ত না করে যার জন্মলাভের প্রক্রিয়াটাও জাগিয়েছে আস্থা। কারণ, বড়ো বড়ো কথা উথলায়নি। সভায় আদর্শমূলক ভাবোচ্ছাসে, মিলনকে আয়ত্ত করার চেষ্টা হয়নি। শুধু মিলনের জয়গান গেয়ে, এই খাঁটি বাস্তব সত্যটার উপরেই বেশি জোর পড়েছে যে এ পাড়ায় হাঙ্গামা হলে সবার সমান বিপদ, এটা মেশাপ পাড়া। হয়তো এ পাড়ায় শুরু হবে না। সে তাণ্ডব, কে জানে। চারিদিকে যে আগুন জুলেছে। তার হলকাতে ছাকা লেগে লেগেই মনে কী কম জ্বালা। সবাহারা শোকাতুর দিশেহারা আপনজনেরা এসে অভিশাপ দিচ্ছে, বলছে মারো, কাটো, জবাই করো, শেষ করে ফ্যালো। এ এসে ও এসে বুঝিয়ে যাচ্ছে মারা ছাড়া বাঁচার উপায় নেই। অনেককালের মেশামেশি পাশাপাশি বসবাস । হয়তো তেমন ঘনিষ্ঠ নয় মেলামেশা সবার মধ্যে, সেটা আসলে কিন্তু এটা শহর বলেই। পাখা সবারই পঙ্গু, মানুষকে হাঁস-মুরগি করে রাখা মৰ্জি মালিকের। পাখা ঝাটিয়ে চলতে হয় জীবনের পথে। আজ এখানে কাল সেখানে উড়ে বেড়াবা ? গাছের ডালে বাসা বানাব ? আর বোলো না ভাই, ইন্দিরা বলে, মাথা ঘুরচে কদিন থেকে। এ সব কী কাণ্ড। অ্যা ! কী झैंथहछन ? তেমন প্ৰাণখোলা আলাপ কিন্তু নয়, কদিন আগের মতো। গলায় মৃদু অস্বস্তির সুর দুজনেরই চোখ এড়িয়ে সস্তপণে জানালা দুটির একটি করে পাট খুলে কথা কইছে, কাজটা যেন অনুচিত ; আসা যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে হঠাৎ । দুজনের বাড়িতেই আচমকা আশ্রয় নিতে আত্মীয়স্বজনের আবির্ভাব ঘটেছে বলেই নয়। শুধু, বাড়ির মানুষ বারণ করে দিয়েছে মেলামেশা, ঘনিষ্ঠতা-অস্তত সামযিক ভাবে । * কী যে হবে ভাবছি। দুধে নাকি বিষ মেশাচ্ছে গয়লারা। দুধ জ্বাল দিয়ে আগে বেড়ালটাকে খানিকটা খাওয়াতে হয়, ছেলেপিলেরা খিদেয় কঁাদে, দেওয়া বারণ। আধঘণ্টা বেড়ালটা কেমন থাকে দেখে তবে ওবা পায়। বুটি আনা বন্ধ করেছেন। বুটি যারা বানায় তাদের মধ্যে তোমরাই নাকি বেশি। এক টুকরো বৃটি আর চা জুটত সকালে, এখন শুধু একটু গুড়ের চা খেয়ে থাকো সেই একটা দুটাে পর্যন্ত। এত লোক বেড়েছে, ডাল-তরকারি ছিটেফোটা একরোজ থাকে, আর একরোজ একদম সাফ । ভাতেও টান পড়ে। আজ চিড়ে খেয়েছি। নুন দিয়ে। গুড়ও নেই। চোখে চোখে চেয়ে খানিক মাথা নিচু করে থাকে দুজন। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় জানালার পাটদুটি । ছেলেমেয়ের সংখ্যাও বেড়ে গেছে দু বাড়িতে। অন্য অঞ্চল থেকে উৎখাত হয়ে তারা বড়োদের সঙ্গে এসে আশ্রয় নিয়েছে। মুখ চেনচিনিও হয়নি বড়োদের মধ্যে কিন্তু ছেলেমেয়েদের কে ঠেকিয়ে রাখবে ? তাদের মেলামেশার দাবি রাজনীতির ধার ধারে না, আপাস অনুমতির তোয়াক্কা রাখে না, জাতধর্মের বালাই মানে না। স্কুল নেই, লেখাপড়া নেই, বেড়ানো নেই, বাড়ির এলাকার বাইরে যাওয়া পর্যন্ত বারণ। বড়োদের মুখ অন্ধকার, বাড়িতে থমথমে ভাব, মুমূর্ষ রোগী থাকলে ঘনঘন ডাক্তার আসবার সময় যেমন হয়। ওরা তাই করে কী, হাবিব আর গীতার নেতৃত্বে নিজেরাই আয়োজন করে