পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র ষষ্ঠ খণ্ড.pdf/১৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছোটোেবড়ো ܬ আহত যাত্রীদের উত্তেজনাই সব চেয়ে কম দেখা যায়। এমনভাবে ক্লিষ্ট হাসি হেসে তারা কথা বলে মাথা নাড়ে যেন বলতে চায়, জগতেব অবস্থা যে কী তারাই তো তার জীবন্ত প্ৰমাণ। ভিড়ের গাদাগাদি। আর অনবরত বাকুনিতে যাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট হবার কথা তাদের সহ্যশক্তি যেমন সবচেয়ে বেশি দেখা যায় অভ্যাস আর অভিজ্ঞতার ফলে, একটা হাঙ্গামায় আহত হয়ে এদের সব রকম দাঙ্গাহাঙ্গামা সম্পর্কে অবজ্ঞা জন্মে গেছে। নতুবা শহরের বিবরণ যেমন ভয়ংকর তাতে গাড়ির কামরায কামরায় ভয়ার্ড কলরব শুরু হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বহুরূপী আতঙ্ক আর কত উত্তেজনা জোগাবে, কত ভীত করবে। মানুষকে ? বেশি বাড়াবাড়ি করলে শিশুও চিনে ফেলে ভয়ংকরকে। একটানা রূপান্তর খেলার শামিল হয়ে গেছে, রোগ দুর্ভিক্ষের নিতালীলার মতো। অন্তত এ গাড়ির একজন মাঝবয়সি মানুষ তো আর কোনোদিন শঙ্কিত হবে না, স্থায়ী রেখায় কপালের চামড়া ভেঁজে কোনোদিন আলোচনা করবে না দেশেব আজ দুর্দিন। তাব দেহযন্ত্রটি বুঝি ট্রেনের সকলেব চেয়ে দুর্বল ছিল, শিশু আব্ব বুড়োদের চেয়েও । শুধু ভিড়েব চাপে গরমে তৃষ্ণায় আর বাতাসের ঘাটতিতে সে শেষ হযে গিযেছে। মরে গিয়েও পড়ে থাকাৰ স্থান জুটেছে প্ৰায লাগেজেরই দুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকার মতো। হাত-পা ছড়িয়ে মরার জায়গারও অভাব ! হাওড়ার সাg, “ ব্রিজ সে আর দেখবে না। তার সাথি ক্লিষ্ট আবক্ত চোখে জানােলা দিযে বাইরে তাকিয়ে ছিল। ব্রিজটি দেখে মুহূর্তেব জন্য তার এসেছিল বিস্মবাণ। হঠাৎ উৎসাহিত হয়ে মুখ ফিরিয়ে সাথিকে জানালা দিয়ে ব্রিজটি দেখার কথা বলতে গিয়ে প্রচণ্ড আঘাতে বাকি খেয়ে আধা-নোয়ানো মাথাটা তাব থমকে গিয়েছিল । ব্রিজ্ঞ। পার তাযে শহবে। ব্রিজেব ঝকঝকে পেন্ট-মাখা বিরাট কাঠামো থেকে শেষ বেলাব পড়ন্ত বোদ ঠিকরে পড়ছে। অসংখ্য চোখে। গুলুব চোখে বিনয়হীন শক্ত বিস্ময়। ধুত্তেরি এটা কী কাণ্ড করেছে ! কী জন্যে কে জানে বাবা ! কত লোক খেটেছে ? ইস আগে যদি শিখত লোহালক্কবের কাজ তো নিৰ্ঘাত এটা তৈরির কাজে লেগে যেত চড়া মজুরিতে। চড়া মজুরি দিত। কিনা সেটা জানা নাই বটে। দিত না। উই, দিত না। এ তো পুল বটে একটা, হােক যত মস্ত আর অবাক মতো, আকাশছোঁয়া, আকাশটার মতো চকচকে। সোন নদীর যে পুল হল সেটাও পুল। বলটু এটে বলটু এটে কী মজুরি মিলেছে ? এ শালার পুল বানাতে পয়সা যদি দুটাে বেশি মিলত তো শালার শহরে চড়া দরে ভাত খেতে তা পুষিয়ে যেত হা, পুল বানিয়েছে দ্যাখো ! দাখো, বিমীর চোখ এদিক পর্যন্ত শানায়, চুড়ি ক-টা বেচে এলাম, হাবাতেরা বুপো দিয়ে পুল বানিয়েছে দ্যাখো ! অনাথের আনাড়ি চোখ থেকে ব্রিজের ঝলমলে আলোর জোয়ার রাস্তা মাটি সবুজ বনের ছোপ। যেন ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে, ঘুমিয়ে স্বপ্নেও যা ভাবা যায় না। কখনও, বুপকথায় রাজপুরী আর ময়দানবের তৈরি সভা মিলেমিশেও হয়ে থাকে ধানের মরাই ঘেঁষা কোঠাবাড়ি আর ওই ইস্টিশন। এটা হবে বুঝি বিলেত দেশটার সদর গেট, না কী বল ? কানুর মা যে ফিরে গিয়ে গল্প করছিল কালীঘাটে ধন্না দিতে এয়ে সে গপ্লের সদর গেট হবে বুঝি। কত্তাবাড়ির গোট কতটুকু, তাতে হাতি বাধা রয় ! আয়গো বড়োকত্তাবাড়ির বেটা ছেলে পরি-সাজা মাগিরা, এয়ে চোখ চেয়ে দেখে যা গেট কাকে বলে ।