পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র ষষ্ঠ খণ্ড.pdf/২৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘর করলাম বাহির মাঝে মাঝে এই হােটেলে খেতে আসি। গরিব মানুষের হােটেল, যারা খেতে আসে তারা অধিকাংশই কারখানা আপিসের মজুর কেরানি। একপ্রস্থ ভাত, ডালের জল আর সবুজ একটা ঘন্ট। আজকালকার বাজার হিসাবে মোটামুটি সস্তা। পাইস। সিস্টেম প্রচলিত, গাটে কড়ি কম থাকলে আধাপেটা সিকিপেটা খেতে বাধা নেই। পেটে অন্তত ভাত পড়েছে। এ সাত্ত্বনাটুকু কেনার সাধ্য এখানে হয়, খিদের সঙ্গে বোঝাপড়া জল দিয়েই করতে হােক। মাছ মাংস পাওয়া যায়, চড়া দাম। অবসাদ বোধ করলে, বড়োলোকের মিথ্যা প্রতারণা ভরা কুৎসিত জগতের ছড়ানো মায়াজালের ছোঁয়াচ লেগে লেগে নিজেকে ক্লেদাক্ত অশুচি মনে হলে, এইখানে এসে বসি । এই মলিন নোংরা পরিবেশে মজুর কেরানির খাদ্য আর খাওয়ার রকম দেখতে দেখতে জগতের সীমাহীন দুৰ্দাস্ত অতৃপ্ত ক্ষুধার অস্তিত্ব অনুভব করি। অসংখ্য চেতনায় তারই প্রতিফলন ঘূণা-যজ্ঞের মহান পবিত্র আগুন হয়ে অনির্বাণ জুলছে, নিজের চেতনায় তার উত্তাপ পাই। নিজেকে সুস্থ, শুচি মনে হয়। প্ৰায় তখন সাড়ে এগারোটা বাজে। সকাল থেকে এটো থালাবাটি তুলে তুলে ন্যাত বুলিয়ে যাওয়ার ফলে খাওয়ার ঘরে বিছানো আসনগুলির সম্মুখের মেঝে চ্যাপচেপে কাদাটে হয়ে গেছে। খাদ্যার্থীদের ভিড় এখন কম। খেতে বসব কিনা ভাবছি। এমন সময় আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, পশুপতি জুতো খুলে খাওয়ার ঘবে একটা আসন দখল কবে বসল। এত বেলায় পশুপতি আপিস যায়নি এটা আমার বিস্মথের কারণ নয়, আমি জান ৩াম তাদেব আপিসে আজ ধর্মঘট । কাছাকাছি একটা ভাড়াটে বাড়িতে পশুপতি সপরিবারে বাস কৰে। বাডি এ৩ কাছে তবু এত বেলায় সে হােটেলে ভাত খেতে এসেছে কেন এটাই আমার কাছে অত্যন্ত খাপছাড়া ঠেকল। আমিও পাশের আসনে বসি, ভাত দিতে বলি। ইতিমধ্যেই পশুপতির খাদ্য এসে গিয়েছিল, হােটেলের ঠাকুর অদ্ভুত রকম চটপটে হয়। পিতলের বাটিতে মশলা গোলা জলের মধ্যে পেন্সিলের দাগ তোলা রবারের মতো মাছের টুকরোটির দিকে চেয়ে পশুপতি বলে, ছ। আনার এই মাছ ! বিলাসিতার দাম দেবে না ? হােটেলেরও তো মালিক আছে ! তা হােটেলে কেন, বাড়িতে রান্না হয়নি ? অসুখ নাকি ? পশুপতি নিশ্বাস ফেলে বলে, অসুখ নয়, যুদ্ধ। কদিন ধরেই চলেছে, আজ চরম সংঘাত। এক পক্ষে আমি অপর পক্ষে বাড়ির সবাই। মানুষকে উত্তপ্ত করলে তার ভাষার জড়তা কেটে যায। আমি ইচ্ছা করেই হালকা সুরে বলি, বাড়িতে ঝগড়াঝাটি হয়েছে, তাই বুঝি চিরকেলে প্রথায় ভাতের উপর রাগ করে বেরিয়ে এসেছ ? সে শান্ত উদার চোখে তাকায়, ঠোটের কোণে মৃদু একটু করুণার হাসি ফোটে। বুঝতে পারি সে ভাবছে : এ লোকটা কোন জগতে বাস করে ! শখের কলহ। আর ভাতের উপর গোসা ! ও সব ন্যাকামির দিন কোন কালে পার হয়ে গেছে। মধ্যবিত্তের জীবনে সে খবরটাও রাখে না ? মুখে বলে, ঝগড়াঝাটি ? ঝগড়াঝাঁটিই বটে । কদিন আজ বাড়িতে পারিবারিক, সামাজিক, দাম্পত্য, রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক যত রকম লড়াই আছে সব চলছে-শুধু বোধ হয় সাম্প্রদায়িক যুদ্ধটা বাদ। বাড়িতে আজ ও পক্ষের হাঙ্গার স্ট্রাইক, রাঁধেনি। আগে থেকে নোটিশ দিয়েছে আজ আপিস না গেলে বরখাস্ত করবে। বাড়ির সকলে তা জানে। এ বাজারে চাকরি পাব ? না খেয়ে মরতেই হবে সকলকে। উপোস করিয়ে মারতেই যখন চাই সকলকে, তাই যখন আমার প্রাণের ইচ্ছা,