পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র ষষ্ঠ খণ্ড.pdf/৩৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

wV8 মানিক রচনাসমগ্র আজ এ সব ছাড়া ছাড়া ছোটোখাটাে কাজের বিশেষ কোনো এফেক্ট নেই। তুমি বলছি নলিনীকে মারতে পারলে এফেক্ট হত, সাড়া জাগত। কী এফেক্ট হত ? কতটুকু হত ? দু-চারদিনের জন্য খানিকটা বেশি। উত্তেজনা। লোকে আবার ভুলে যেত। লোকে আজ অনেক বড়ো কিছু চায়, ব্রিটিশ শাসনের ধ্বংস, এখানে ওখানে ঘা মেরে গায়ের ঝাল ঝেড়েই তারা সন্তুষ্ট নয় ! নলিনী কেন, আজ লাটসায়েবকে মারো, লোকে চমকে উঠবে, বলবে একটা কাণ্ড হল বটে, বাস, তাব।পর চুপ হযে, যাবে। এ তো শুধু একটা ঘটনা। ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের একটা চাকরকে মারলে, গবর্নমেন্টটা তো মরল না । লোকের মনে যদি বিশ্বাস আনতে পার যে এটা নিছক ঘটনা নয়, এটা বিপ্লবের আহ্বান, প্রস্তুতি, বিপ্লবের পথে স্বাধীনতা লাভের আয়োজন চলছে, এ বকম ছোটো ঘটনার চেহারাও সঙ্গে সঙ্গে লোকের কাছে বদলে যাবে। নারাণের ছেলেখেলাটুকুর মধ্যেও তখন লোকে দেখতে পাবে, তাদের শহরেও বিপ্লবের লড়াই শুবু হয়ে গেছে। বিয়েল আসরে অমিতও শুনতে পাবে লোকে ওই কথা কানাকানি করছে। লোকে জানবে কী করে বিপ্লবের চেষ্টা হচ্ছে ? নারায়ণ বলে, হাত গুটিয়ে বসে থাকলে ? কালীনাথ বলে, দুটাে উপায় আছে। চারিদিকে একটার পর একটা ছোটাে ছোটাে অপারেশন ক্ৰমাগত চালানো কিম্বা কোথাও বিরাট স্কেলে একটা অপারেশন প্ল্যান করা। শুধু এইভাবে তুমি দেশের লোককে জানাতে পার তোমার রিভোলিউশনাবি প্ল্যান আছে, অগনিজেশন আছে, তুমি लgाई 5'3 । তার স্কোপ পােচ্ছ কোথায় ? নারায়ণ বলে, ছোটাে স্কেলে অনেকগুলি হোক আবা বড়ো স্কেলে একটাই হােক, তার জন্য লোক চাই। দু-একটা নমুনা দেখিয়ে নাড়া দিয়ে সাড়া না জাগিয়ে তুমি লোক টানবে কী করে ? এটা আপনার ভুল হল, অমিতাভ প্রতিবাদ জানায়, নমুনা যথেষ্ট দেখানো হযেছে, আমবা যখন আঁতুড়ে তখন থেকে দেখানো হচ্ছে। ক্ষুদিরাম শুরু করে আজ পর্যন্ত কম লোক কম নমুনা দেখাননি। আজ ও বকম নমুনার দরকার নেই, কালীনাথ জোর দিয়ে বলে, লাভও নেই ওতে। শুধু শক্তি ক্ষয়, কাজের অসুবিধা। বিপ্লব গড়ে তোলার নমুনা দেখাতে পার দেখাও, নয় চুপচাপ থাকাই ভালো। তোমার ফ্যান্সি-মতো অপারেশন গড়তে যদি দু-চারবছব লাগে ? লাগবে। জুড়িয়ে বরফ হয়ে যাবে না দেশটা ? যে কজনকেও পেয়েছ। কাজেব জন্য তারা ধৈর্য হাবাবে না ? ঝিমিয়ে পড়বে না ? ছিটকে বেরিয়ে যাবে না। অন্য দলে যারা অন্তত হাতেনাতে ছোটােখাটোও কিছু করছে আমার ছেলেখেলার মতো ? এ যুক্তি উড়িয়ে দেবার মতো নয়, এ সমস্যা কালীনাথকেও বিব্রত ও চিন্তিত করে রেখেছে। বিপ্লবেব জন্য প্ৰাণ দিতে যে তরুণ এগিয়ে আসে কিছু করার জন্য এমন সে ছটফট করে, কাজ চাই, কাজ, বিপজ্জনক রোমাঞ্চকর গুরুতর কাজ !-প্ৰাণ দিতে একটু বিলম্ব যেন সয় না। কিছু করার জন্য, তাড়াতাড়ি করার জন্য, দলের এই চাপ বিপন্ন অস্থির করে তোলে নেতাকে। কিছুদিন ঠেকিযে রাখা যায়, আরও বেড়ে যায় সবার উৎসাহ ও আগ্রহ। কিন্তু একেবারে কাজের খোরাক না পেলে তারপর ঝিমিয়ে আসে, বাড়ে অস্থিরতা, চাঞ্চল্য, বিরক্তি, অবসাদ। কেউ কেউ সত্যই দল ছেড়ে দিয়েও চলে যায়। একেবারে বিপ্লবের পথ ত্যাগ করে নয়, চলে যায় অন্য সক্রিয় দলে, যারা শুধু প্ৰস্তুতি নিয়ে নিস্ক্রিয় হয়ে নেই। কিছু করার অদম্য আবেগকে খানিকটা শাস্ত রাখা যায় দলের কাজ দিয়ে, যাতে দায়িত্ব বিপদ আর গোপনীয়তার রোমাঞ্চ আছে। কাজ উদ্ভাবনাও করতে হয় কিছু কিছু। তবু আয়ত্তে রাখা কঠিন হয় উৎসাহী। সেই জন্যই তো আমাদের ঐক্য দরকার, মিলেমিশে প্ল্যান করা দরকার যতটা সম্ভব, ট্রেনিং যাতে আদর্শ আর কাজের সামঞ্জস্য রেখে হয় তাও দেখা দরকার।