পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র ষষ্ঠ খণ্ড.pdf/৩৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জীয়াস্ত \5)ዒ d: বীজের নমুনা আনিয়ে বিঘাখানেক জমিতে ভালো চাষের নমুনা দেখানোয়, ষাঁড় আনায় সাহায্য ও সহযোগিতা করে। সারা জেলায় আর তার আটলিগাঁয়ে খাজনা বন্ধের তোড়জোড় দেখে বসন্তু ও তার অনুগত কয়েকজন কংগ্রেস-কমী ভড়কে গিয়েছিল। তাদের বাধা অগ্রাহ্য করে সাধারণ কংগ্রেসকমীদের উৎসাহ ছিল আরও একটা ভয়ের কারণ, এর আগে কখনও তারা এ ভাবে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেনি। আর এমন আশ্চর্য ব্যাপার, বড়োলোক নয়, নাম-করা লোক নয়, গোরস্ত চাষি, ধীর সংযত ধনদাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল আটুলিগীর খাজনা বন্ধের নিয়ন্তা। সে যোগ না দিলে ভাগ হয়ে যেত আট্‌লিগার চাষি সমাজ, অত প্ৰচণ্ড হত না আন্দোলন, মাথা তুলে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে ফেঁসে যেত। জ্ঞানদাসের জন্যই ধনদাসকে খাজনা বন্ধে যোগ দিতে হয়। লোকটার ভাই-অস্ত প্ৰাণ। অদ্ভুত আশ্চর্য সেই দিনগুলি, ভয়ানক দিনগুলি, মনে গাঁথা হয়ে আছে পাঁচুর। পাকাকে সে ছাড়া ছাড়া ঘটনার গল্প বলে, কোন বাড়ি পুড়েছিল, কার ঘরের লোক মরেছিল, দেখিয়ে দেয়। জ্ঞানদাস এবং ধনদাসও তাকে পাঁচুর মতোই সে সব ঘটনার উলটাপালটা এলোমেলো টুকরো টুকরো বর্ণনা শোনায়। শুনতে শুনতে কল্পনায় সাজিয়ে গুছিয়ে এক বিরাট অবিশ্বাস্য অভু্যত্থানের, এক আশ্চর্য সংগ্রামের কাহিনি গড়ে তোলে পাকা, শন-খড়-মাটির কুঁড়ে ঘবের এই আটুলিগী ছিল যার আস্তানা, খালি গা খালি পা এই শান্ত নিরীহ মুক চাষিরা ছিল যার অংশীদার। জীবনে আর এমন কাহিনি শোনেনি পাকা। আট্‌লিগা তার চোখে বদলে যায়। সুমনি কিছু, ধনদাস বলে নারকেল ছোবড়া পিজিতে পিজিতে, তবে হ্যা, মিছে মন কষাকষিটা কমতি দেখা যায়। অতটা কথায় কথায় বিবাদ করা মামলা করা নাই। অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে আবার বলে, মেজাজ খানিক গরম হয়েছে সবার, তেজ বেড়েছে। দুটা চড়াচাপড় চুপচাপ সয়ে যাবে তো তিনটে চড় কোনোমতে আর সইবেনি। মোদের চাষিবাসিব মন্দিা গায়ের জ্বালা কম ছিল, শোকতাপে মারি তো গা জুলবো কীসে ? জ্বালাটা বেড়েছে। ইদানীং, ইদিকে ফের শোকতাপে কঁাজ কম, দুঃখু কম। হাতের কাজ বন্ধ রেখে মুখ তুলে সে তাকায় ভাইয়ের দিকে। এ ভাষা ভালো বোঝে না পাকা। তবে জানে যে তার কাছে। এ সব শব্দ আর সংজ্ঞাগুলির যে মানে, ধনদাসের মানে তার চেয়ে আলাদা। মোটামুটি ওরা কী বলতে চায় সে তাৎপর্যটা সে ধরতে পারে, গভীবতা এড়িয়ে যায় তাকে। জ্ঞানদাসের কথারও অনেকখানি মর্মার্থ দুর্বোধ্য থেকে যায়। বড়ো ভায়ের মন্তব্যের প্রতিবাদে অ’ সমর্থনে সে ফসলের কথা তোলে সেটাই ধরতে পারে না পাকা। জ্ঞানদাস বলে, কদিন হল ধান ঘরে তুলেছি মোরা ? এব। মন্দিা যেন চুকে বুকে গেছে সব কিছু, যেন বাছুর মরা গাই, বাস, আর কী রইতে পারে ? তা কী করবে মানুষ বলতে পাের ? পেটের তাপে গা জুলায় তা শোকতাপ কী, অদেষ্ট কী ভিতরে ঘা, তো বাইরে মলম দিলি জুড়ায় ? ও শাস্তির কাজ না । বটে তো, বটে তো, ধনদাস বলে, তবে কি-না না-হক ঘাটায়ে লাভটা কী, তাই বলি। হিসেবের কড়ি বাঘে খায় না তা সে পয়সা বল, বীরপনা বলা ! অন্যায় তো ছিল, আছে, রইবে জগতে, না। কি স্বাগগ হবে পিথিমি ? সইবে না তো হিসেব কর লাভ কি লোকসান কত, না তো দশটা সইবে আর একটার বেলা সইবো না বলে খেপে ডঠে ক্ষেতি করবে আপনার, উয়া বোকার কাজ, গোয়ার্ভূমি। যুধিষ্ঠির লড়েনি, মারেনি শতুর কুরুক্ষেত্রে ? তা ফের গাল অপমান সয়েও ছিল দুযুদ্ধনের ঠাই ঘাড়টি হােঁট করে। পাকার মুখের দিকে চেয়ে বলে, ধর না কেনে, মিত্যুভয় নাই, মস্ত সাহসী পুরুষ একজনাতাই বলে কি খালি হাতে লড়তে যাবে বাঘের সাথে যেচে যেচে ? না তো কি বাঘে ধরলে নাক কান বুজে। মরবে। চুপচাপ ? জ্ঞানদাস বলে গরম হয়ে।