পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র ষষ্ঠ খণ্ড.pdf/৩৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

voro মানিক রচনাসমগ্র —এদের ফিলজফি অদৃষ্ট। মেয়েরা যত ছেলে বিযোয় অর্ধেকের বেশি মরে যায় আঁতুড়ে, নয়তো বড়ো হয়ে। আকাশের দিকে চেয়ে পুরুষরা জমি চাষে, বৃষ্টি না হলে মরবো, বেশি বৃষ্টি হলেও মরবো। এবার দেখছ তো অবস্থােটা ? বন্যা ঘায়েল করে দিয়ে গেছে। শুধু এ বছর নয়, আর বছরও । বন্যার ধাক্কা সামলে ভালো ফসল ফলাতে একটা বছর বরবাদ যায়। জীবনে এই বোধ হয় প্রথম পাকা নিজে মুখ না খুলে একজনের কথা শুনে যায়, এই ধরনের কথা ! এটা তার খেয়াল হয়েছিল। পরে, শহরে ফিরবার পর, এক অবসর-মুহূর্তে। শ্যামল জানার খড়ের বাড়ি। দুটি ভিটের ঘর বাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে আছে, একটি ভিটের ঘর সে সারিয়ে নিয়েছে মোটামুটিভাবে। জীবনযাত্রা তার সহজ অনাড়ম্বর। একা থাকে, নিকট আপনজন বলতে এক ভাই, যে আজ দশ-বারোবছর চাকরি নিয়ে বর্মীয় প্রবাসী। মাঝখানে একবার মাত্র দেশে এসেছিল ছুটি নিয়ে, কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে ছিল। পিসি সম্পর্কে পাড়ার এক প্রৌঢ়া বিধবা বেঁধে দিয়ে যায়, নিজেও খায়। শ্যামলের চেয়ে তার নিজের নিরামিষ রান্নাই বোধ হয় বেশি। পদের আর বেশি মুখরোচক হয়। শ্যামলের মধ্যাহ্নের ভোজন হল শুধু জলে সিদ্ধ করা কুচি করে কাটা একটু তরকারি, ছটাক খানেক ছোটাে মাছ, দু-তিন চামচ ঘরে পাতা দই আর একেবারে জাউ করে ফোটানো আধমুঠি পুরনো চালের ভাত। রাত্রের ভোজন দুধ আর খই। সন্ধ্যার আগেই পিসিমা ভাগে। এই জেলখাটা খুনের বাড়িতে সন্ধ্যার পর একদণ্ড থাকতে তার ভরসা হয় না। বেঁচে থাকার জন্যই তার এই বিলাসিতা ! বঙ্গ-ভঙ্গ যুগের বোমারু দলের বিপ্লবী, বছর কযেক আগে সরকার সদয় হয়ে তাকে ছেড়ে দিয়েছে-জীবন্মুত অবস্থায়। পাকা প্রশ্ন করে, কেন ছাড়ল ? হ্যারিকেনের আলোয় তার পাশুটে ঠোঁটের হাসিও যেন ঈষৎ বঙিন মনে হয় : ওরা হিসেব করেছিল, বড়ো জোর পুরো একটা মাস ! ডাক্তার বাজি রেখে বলতে পারত, দু-তিনমাসের বেশি। শ্যামল জানা পৃথিবীতে টিকতে পারে না, দুমাস যদি টেকে তো সেটা হবে জগতের আর একটা পরমাশ্চর্য ব্যাপার । নইলে কখনও ছাড়ে ? শ্যামল একটু থামে। এটা তার স্বভাব। দেশ জুড়ে আবার যখন নতুন কবে শুরু হযেছে সেই সময় ? ইংরেজের হৃদয় নেই, ওরা ড্যামকেয়ার করে সেন্টিমেন্ট। ওদের মতো হিংস্র নেই, ধীর শাস্ত হিসেবি হিংস্র । ওদের স্বার্থে ঘা দিয়েছিলাম, তেরো বছর ধরে আমায় ভেঙে চুরমার করেছে বলেই ওদের প্রতিহিংসা মিটেছে ভাবো ? তাই ছেড়েছে আমায় ? শ্যামল হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে, যেন সত্যই প্রশ্ন করছে, জবাব চায়।-দু-চারমাসে মরবাই না জানলে কখনও ছােড়ত না। মরাই যখন নিশ্চয় বাইরে এসে মরি। উদারতাও দেখানো হবে, বিনা যত্নে বিনা চিকিৎসায় মরলে দেশেও একটা কলঙ্ক হবে। পাকা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে, শ্যামল যেন তার কথা বলছে। রাজনীতি সে বোঝে না, সম্প্রতি হৃদয় তার পুড়তে আরম্ভ করেছে ব্রিটিশ-বিদ্বেষে শুধু এই জন্য যে হাজার হাজার মাইল দূরের ছোটাে একটা দ্বীপের কয়েকটা লোক তার এতবড়ো দেশের কোটি কোটি মানুষকে শাসন করছে, দু-একদিন নয়, দেড়শো দুশো বছর ধরে। স্কুলে ইতিহাস পড়ায়, কিন্তু ইতিহাসের এক কণা মানেও সে বোঝে না, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন থেকে পলাশীর যুদ্ধের ফলাফল থেকে, যত কিছু ঘটে এসেছে সব তার কাছে উদ্ভট অবিশ্বাস্য মনে হয়। জাহাজে করে একমাস দেড়মাসের পথ যে ছোট্ট দেশ, সে দেশ থেকে এসে সারা দেশটা তারা দখল করল ! একদিনে কয়েক ঘণ্টায় যাদের এই সামান্য কয়েকজনকে লোপাট করা যেত, খবর পৌঁছে আবার জাহাজে করে যাদের সাহায্য আনতে সময় লাগত। দু-চারমাস, তারা খেলার ছলে পদানত করল দেশটা ! তার মানেই আমরা