পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র ষষ্ঠ খণ্ড.pdf/৪০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জীয়ন্ত 8ひ@ সুরেন বলে, তাই যদি না হবে। তবে একটা কথার জবাব দাও । মুসলমান নেই কেন আমাদের মধ্যে ? কেন তারা আসে না ? বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে শওকতের মতো ছেলে, কেন তার মন বিগড়ে যায়, আমাদের পথ ঠিক নয় বলে কেন সে মাথা ঘামাতে বসে রাশিয়ায় কী হচ্ছে, মার্কস লেনিন কী বলেছে তাই নিয়ে ? ওরা একদিন রাজা ছিল এ দেশে, ওদের গা জ্বালা করে না কেন, ইংরেজ না তাড়িয়ে ঘুমোয় কী করে ? আপনি উলটোেপালটা কথা বলছেন, অমিতাভ বলে, গত আন্দোলনে ওরা যোগ দিয়েছে। নিরামিষ আন্দোলন ! কান্নাকাটি উপোস করার আন্দোলন ! মেঘেন মুখ বাকায়। এটা তাদের সকলেরই মনের কথা। আন্দোলনটার বিরাটত্বের জন্য কিছুকাল আগে পর্যন্ত মনে যে কিন্তু কিন্তু ভাবটুকু ছিল তাদের, তাও দ্রুত উপে যেতে আরম্ভ করেছে। বরং দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে যে অভূতপূর্ব সাড়া জাগার জন্য আন্দোলনটার বিরাটত্ব, আন্দোলনের ব্যর্থতা বিরুদ্ধ মনোভাবটাই উগ্র করে তুলেছে। আমরা ওদের টানবার চেষ্টা করি না বলেই হয়তে ওরা আসেনি। আমরা হিন্দু ছেলেই দলে টানি-আমাদের কে টেনেছিল ? শুধু আমাদেরই কেন মাথা ব্যথা ? আমাদের ধর্মে, আমাদের সভ্যতায় এমন বিশেষ কিছু না। যদি থাকবে এতকাল ধরে শুধু আমাদেরই বোমার দল হত না কালীনাথ । এ সব কথা তলিয়ে কেউ ভাবেনি, বুঝবার চেষ্টা করেনি কোনোদিন। আজ কিনা তাদের সতেরোই ৩১খের অনেক কষ্টের আয়োজন বাতিল হয়ে যেতে বসেছে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গায়, আজ কিনা কথা উঠেছে বিপ্লবীর ধর্ম-বিশ্বাসের, আজ এই ভয়ঙ্কর প্রকাণ্ড বাস্তব সত্যটা বৃঢ়ভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে যে হিন্দু-মুসলমানের এ দেশটার জন্য সশস্ত্ৰ বিদ্রোহের দল গড়ছে শুধু হিন্দু ! কল্পনায় আর পরিকল্পনায় আছে অনেক কিছু, দেশের যে যুবশক্তির ব্যাপক বিদ্রোহের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে ইংরেজের শাসন তার জাত ধর্ম প্রদেশ থাকবে না, স্বাধীনতা আসবে না বিশেষভাবে এর জন্য অথবা ওর জন্য,--কিন্তু আগুন জ্বালাবার ভূমিকা তো শুধু তাদেরই দাঁড়িয়েছে। কেন এমন হয় ? কী মানে এই অসঙ্গতির ? অস্পষ্ট জিজ্ঞাসার অসীম গুরুত্ব অনুভব করে তাদের হৃদয় উতলা হয়, মনে হয় জীবন দিতে এগিয়েও অনেক কিছু ভাবা হয়নি। জীবন এত বৃহৎ, এমন ব্যাপক আর সামঞ্জস্য-বিরোধিতায় এত বেশি দুর্বোধ্য তার সমগ্ৰ মূর্তি যে তাদের মতো দু-চারশোর দু-চার হাজারের জীবন-পাণ ব্ৰতপালন সেই বিস্তুতিতে দু-চাবটি ঢেউ ছাড়া কিছু নয়। এ চিন্তা বড়ো ক্লেশকর তাদের পক্ষে। বৃহতের চিস্তা কেন উদবুদ্ধ করার বদলে হতাশা অবসাদ ঘনিয়ে আনে কে জানে ! মেঘেন যেন সুযোগ বুঝেই গোড়ার কথায় ফিরে আসে, মা কালীকে অত তুচ্ছ করে উড়িয়ে দিয়ে না। কালীনাথ। সবই বুঝি, তবু সোজা কথাটা কী জানো, এমনই কথায় কথায় একটা প্ৰতিজ্ঞা করায় আর গভীর রাত্রে নির্জন মন্দির ছুয়ে প্রতিজ্ঞা করায় তফাত আছে। মানুষ তো আমরা। বীরেন বলে, থাকগে ও সব কথা, কাজের কথায় এসো। যা বুঝি না সে সব ইঙ্গিত সংকেত নয়, মুশকিলটা কী, সব বানচাল হবে কিনা হিসাব করে দেখা যাক। আমার হিসাব করা আছে। কালীনাথ বলে তার হিসাবে, অসুবিধা যা দাঁড়াচ্ছে তা আর কিছু নয়, টাইম ফ্যাক্টরের অসুবিধা, শহরে অফিসার ও সশস্ত্ৰ পুলিশের সংখ্যা বেড়েছে, পুলিশ অনেক বেশি সতর্ক, খবর পেলেই ছুটে যাবার জন্য সব সময়ে প্রস্তুত। সাধারণ অবস্থায় ভুবনের বাড়িতে মাঝরাতে হানা দিতেই চারিদিকে সোরগোল উঠলেও, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দিতে লোক ছুটে গেলেও, টাকাটা বাগিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ার যথেষ্ট সময় তারা পেত। এখন তার চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি পুলিশ এসে পড়বে। সৈন্দবাজারের মোড়ে যে আর্মড পুলিশের ঘাঁটি পড়েছে সমাদারদের বাইরের দালানে, সেখানে আজ