পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র ষষ্ঠ খণ্ড.pdf/৪১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 Y S মানিক রচনাসমগ্র এ সব পাকারই জীবনের এক পরবতী অধ্যায়ের চিস্তা। এ দিনটির অভিজ্ঞতা বারংবার ঘুরে ঘুরে তার মনে পড়েছে বরাবর। দুটি বিশেষ কারণে অমিতাভের মৃতদেহের সামনে বসে গভীর হতাশার সঙ্গে জীবনে প্রথম এক অদ্ভুত অসহায়তা বোধ করে উতলা হওয়া আর ধুতি ও শার্ট কোট পরা মাথায় পাগড়ি বাধা প্ৰতিমাকে দেখে সমস্ত দেহে মনে মনোরম এক উত্তাপের সঞ্চারে উষ্ণ ও আনন্দিত হওয়া। NR দেখা-শোনা সেবা-যত্ন যা-কিছু করার করছে শ্যামল জানার পাতানো পিসি। বয়সে সে শ্যামলের সমান হবে। কাল থেকে পিসি অবিরাম বিড়বিড় করে বকেছে আপন মনে, কাপের পর কাপ চা তৈরি করে দিয়ে মাছ তরকারি রোধে বেড়ে খাইয়েছে। হাসপাতাল হয়েছে বাড়িতে, খুনে ডাকাত কুটুম এসে ভিড় করেছে খুন্নেটার ঘরে। পুলিশ এবার ধরে নিয়ে পিসিকে নিশ্চয় ফাঁসি দেবে। কিন্তু এতদিনের নিয়মভঙ্গ করে পিসি কাল সন্ধ্যা হতে বাড়ি যায়নি। ভোর ভোর এসেছিল কাল পিসি, প্রায় রাত থাকতে। কাশতে কাশতে আগের দিন একটু বেশি কাবু হয়ে পড়েছিল শ্যামল। শ্যামলকে বিছানায় শুইয়ে খানিকক্ষণ গোমড়া মুখে তাকিযেছিল। তারপর নিজেই বলেছিল, না, আমি রইবনি। করব কি রয়ে ? কেশে কেশে মরো নয়তো বঁচে যদি মরণ ঠেকাতে পাবব ? মোর বাপু বেতো ব্যারাম। শ্যামল কেশে কেশে রাতারাতি মরছে না বেঁচে আছে জানতে বুঝি সকাল হওয়ার তব সযনি পিসির। এসে রাতারাতি বাড়িতে ব্যান্ডেজবাধা কেষ্ট ও অমিতাভ এবং আরও তিনজন অতিথির সমাগম হয়েছে দেখে তার মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল। আর ঠান্ডা হয়নি। সন্ধ্যার পর শ্যামলের মৃত স্তিমিত চােখে নতুন প্রাণের দীপ্তি দেখে বলেছিল, ফুর্তি কীসের শুনি ? খুনে ডাকাত কুটুম সাঙােত পেয়ে ? এ মায়ের বাছটার যে জ্ঞান হল না খেয়াল আছে ? বেতে রাইতে হবে তো মোকে ? রইব না, মোর গরজ নেই ! কিন্তু পিসি রয়েছিল। নিজের গরজে। পিসি চা এনে দেয়। প্রতিমার বেশ তার চোখে পড়ে না। কেউ কঁদছে না দেখে তার অসহ্য ঠেকে। কেন, আপনজন কি কেউ আসেনি যে ছেলেটার জন্য একটু কঁাদে, এমন বেঘোরে বেকায়দায় যে ছেলেটা মারা গেল ? এ সব বাবু বোঝে না সে, সজল চোখে পিসি জানায়। ইংরেজরাজ সবাইকে নিত্যি চোখের জলে ভাসায় বলে ইংরেজ মারতে খুনে হয়েছে, তাই বলে কি আপনার লোক মরলে পরেও চোখের জল ফেলা বারণ ! বীরত্ব করে কেউ মরেছে বলে কঁদতে পাবে না। তার আপনজন ! মরেনি পিসি, এ ছেলেরা মরে না। মরলে পরে দুদিন কেঁদে ভুলে যেত, এ ছেলেকে কেউ কোনো দিন ভুলবে না। এখানে তীর্থ হবে, দূর থেকে লোক ভিড় করে দেখতে আসবে। শ্যামল বলে কথাটা। ভাবাবেগের সঙ্গেই বলে, কারণ জেলে জেলে আর আন্দামানে জীবনের সঙ্গে তার ভাবপ্রবণতাটাই সব চেয়ে বেশি ক্ষয় হয়ে গেছে। শক্তি থাকলে সে আকুল হয়ে কঁাদত, কারণ কান্নায় তার দুর্বলতার লজ্জা নেই, হৃদয়কে দমন করার কঠোর সংযমের প্রয়োজন তার ফুরিয়ে গেছে। তবে তার কথায় সবার রাঙাটে চোখগুলি জলে ভরে যায়, কালীনাথের চোখ পর্যস্ত। প্রতিমার গাল বেয়ে ধারা নামে। বােঝা যায় গেয়ে পিসির মূল্যবিচার অভ্রান্ত, খুনে বিপ্লবীদেরও একটা দিক নরম থাকে, মানুষ থেকে গিয়ে যা কঠিন করা অসম্ভব। এটা যেন পাকার জিদের জয়।-সে। ভাবে, কুঁঃ নইলে তোমাদের এত কড়াকড়ি কি জন্যে শুনি কালীদা ? আমার তোমরা নাম কেটে দাও। আমার মনের জোর নেই।