পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র ষষ্ঠ খণ্ড.pdf/৪৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8vaV2 মানিক রচনাসমগ্ৰ রাখত, কোথায় ছিটকে চলে যেত তারা জীবনের বিভিন্ন গতির টানে ! তিনু যেমন গেছে, ধনেশ মুদির ছেলে তিনু। সেও আছে এই শহরেই, অত তার বন্ধুপ্রেম, তিনবন্ধুকে দোকানের লজেন্স বিস্কুট তামাক খাওয়াতে অত তার ব্যাকুলতা, কিছুই তো তাকে ধরে রাখতে পারল না বন্ধুচকে। তিনজনেই ভালোবাসত তিনুকে। অথচ পাকাকে এত অপছন্দ করলেও, পাকাকে বর্জন করলেও পাকার সঙ্গে নিবিড় যোগ কানাইয়ের রয়েই গেছে : তিনজনের কারও আজ মনে পড়ে না। এই সেদিনও তাদের যে আর একজন প্ৰাণের বন্ধু ছিল, সেই তিনু গেল কোথায় ? সাধারণ বন্ধুত্ব সুযোগ সুবিধার ব্যাপাব। বিপ্লব বন্ধুত্ব গড়ে অন্যরকম। নতুবা জগতে বিপ্লবী হত কে ? } পাকার সৎমার নাম সরমা। সতেরো বছর বয়স, গরিবের মেয়ে। এখানকারই গরিব স্কুলের গরিব মাস্টার সারদাচরণ তার বাপ। সৌন্দৰ্য চলনসই, স্বাস্থ্যটা সুন্দর। স্কুল মাস্টার বাপ, তাব ভাতে এমন শরীর এ দেশে গড়ে ওঠে না। বাড়তি খাদ্য সংগ্রহের একটা আশ্চর্য প্রতিভা ছিল সরমার, পেযারা পাপর ছোলা চানাচুর বাদামভাজা তো বটেই, স্বভাবগুণে কয়েকটা বাড়িকে বশ করে মেযেব মতো হয়ে ভালো খাদ্যও সে পেত। পাড়ার পাতানো মাসি পিসি খুড়ি জেঠি দিদি বউদিরা তাকে দেখেই খুশি হত, শান্ত নরম স্বভাব, হাসিমুখে কথা বলে, দুঃখে কষ্টে দরদ দেখায়, সখে সৌভাগ্যে আনন্দ পায়,-সবচেয়ে বড়ো কথা, বাড়িতে এসে যেটুকু সময় সে থাকে, বাড়ির মেযেব মতো না-বলতে সংসারের ঝঞাটি লাঘবে হাত লাগায়। ছেলেটা ধরা থেকে ভাতের হাঁড়িটা নামানো, ঘবটা কীট দেওয়া থেকে চট করে দুটাে বাসন মেজে ফেলা, কোনাে কাজ করতেই তার অহংকার নেই। তাই শুধু নয়, নিজে বুঝে নিজে এগিয়ে নিজে থেকে করে দেয়। মাছ মাংস, দই মিষ্টির ভাগ তাকে না দিযে খেতে কয়েকটা পরিবারের রীতিমতো মন খুঁতখুঁত করত। বিশেষ কিছু রান্না হলে সে হাজির না থাকলেও ছোটো ছেলেমেয়ে পাঠিয়ে তাকে ডেকে আনা হত ; ও সরমা, আমি ডাল রোধেছি, দাখ তো খেয়ে হয়েছে কেমন ? বাড়ির কাজে ফাকি পড়ত, বাড়ির মানুষ খাপ্পা হত, কিন্তু কোনো শাসন মানত না। সারমা। তার দারুণ খিদে, পেট ভরে না, বড়ো বড়ো কথা বললে চলবে কেন ! যতটুকু খেতে দেবে ততটুকু খেটে দেব, ঘর-পর নেই। না জেনে বুঝে ভদ্র সমাজের সব নিয়ম রীতি স্নেহ প্রীতির বাঁধন বজায় রেখে তারই মধ্যে এই নীতি গড়ে তুলে মানিয়ে চলা একটি মেয়ের পক্ষে সহজ প্রতিভার কথা নয়। অরবিন্দের বয়স নিয়ে দারুণ ক্ষোভ হয়েছিল অবশ্যই। শত গরিবের মেয়ে হােক, বুড়োর কাছে বলি দেওয়াটা সব মেয়েই বোঝে, হােক সে বড়ো সরকারি চাকুরে, মস্ত পয়সাওলা লোক। এ বাড়িতে মাছ দুধ খাবার-দাবারের অঢেল ব্যবস্থায় সরমা গোড়ার দিকে মরমে মরে গিয়েছিল। চিরদিন তার খিদে বেশি, তাই যেন সে প্রচুর খাদ্য পেল বরের বদলে। কিছুদিন কোনো জিনিস তার মুখে রোচেনি, খেতে বসে ঠেলে ঠেলে দিয়েছে সব। তাতে একদিকে ভালেই হয়েছে। নতুন বউয়ের পক্ষে মানানসই ব্যবহার হয়েছে। খিদে কদিন বিগড়ে না গেলে প্রথম থেকে সে যদি খিদে মিটিয়ে খেত, অন্যে তো হাসাহসি করতই, অরবিন্দেরও লজ্জা হত। খিদে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। সারমার যথাসময়ে, কিন্তু সে তখন বাড়ির গিন্নি, কী সে খায়, কত খায়, কবার খায় কে তা দেখতে যাচ্ছে বি-চাকর ছাড়া, বিশেষত যে বাড়িতে খাদ্যের ছড়াছড়ি, এমনই কত নষ্ট হয়, ফেলনা যায় ।