পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র ষষ্ঠ খণ্ড.pdf/৪৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

888 মানিক রচনাসমগ্ৰ চেতনার প্রান্ত দুয়ে। ডোবা হয়ে নালা বেয়ে সাগর দুয়েছে, ওই অসীম অগাধ জীবনের জোয়ার-ভাটা তার জীবনেও বয়। শহরে পড়তে গিয়ে অন্যজাতের কজন লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে বলে খুব বেশি আসে যায় না। চেনাজানা অভ্যস্ত পুরুষানুক্ৰমিক ছোটাে হেঁটাে ডোবায় ডুবে থাকলে কোনো হাঙ্গামা নেই। গায়ের আরও দু-চারটি চাষির ছেলে খানিক লেখাপড়া শিখেছে, পাঁচু এক নয়। একটু অন্যরকম, একটু খাপছাড়া হলেও তারা মোটামুটি মানিয়ে নিয়েছে, লেখাপড়া ভুলেটুলে গেছে, বেনো জল ঝেড়ে ফেলেছে। পাঁচুর হয়েছে এই মুশকিল যে টুইয়ে গড়িয়ে আসা জল যেন নয়, জীবনসমুদ্রের তরঙ্গ এসে হানা দিয়েছে তার ডোবায়-বেচারি ছেলেমানুষ, জমি-চষা চাষির ছেলে। স্রেফ সে ভুলে গেছে নিজের কথা। নইলে এত বৈচিত্রা, এত রোমাঞ্চ, এত অর্থকরী সম্ভাবনার ইঙ্গিতগুলির সঙ্গে সে এটে উঠতে পারত না। সে সবল কী দুর্বল, বাহাদুর কিংবা সামান্য, বিচারবিবেচনার অধিকারী অথবা বেয়াদপ, সব ভাববারও তার সময় নেই, দ্বিধা সংশয় প্রতিক্রিয়াও নেই। কদাচিৎ তার যে আত্মবোধ জাগে বিষাদ বেদনার গ্লানির রসে টইটম্বর হয়ে পাকার আহ্বানে ঢাকা যাবার সময় স্টিমারে এবং ঘুমন্ত পাকার খাটের মশারির বাইরে দাঁড়িয়ে নতুন মামির আলুথালু বেশে কান্না দেখার রাত্রে, তাও আসলে পাচুর নিজের কথা ভেবে নিজে বিচলিত হওয়া নয়। তার ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই, সে কেন ও রকম নিদারুণ মনোকষ্ট পারে পরের জীবনের বিরোধ আর জটিলতায় ! জীবনে যত নতুনত্ব এসেছে। ওটা তার সে সব আয়ত্ত করারই প্রক্রিয়া। কালীনাথ বল, শ্যামল বল, পাকা বল, কানাই বল-আত্মচিন্তা ওদের পাগল করেছে, আমিত্বের পরাধীনতা ওদের বেঁচে থাকাই ব্যর্থ বিশ্ৰী বেদনাদায়ক করে স্বাধীনভাবে বঁাচার জন্য ফাঁসিকাঠে ঝুলে ঝুলে মরাকেও বড়ো করেছে। ওদের সংস্পর্শে এসে এই জুলার ভাগও পাচুকে নিতে হয়-বিরোধী জগৎকে একেবারে ভেঙে চুরমার করে ফেলার যে আকাশ-ছোঁয়া স্পর্ধা পাকার, সে স্পর্ধার সামান্য অংশটুকু পেতে হলেও জগৎকে বিরোধী করার যে দারুণ মনোকষ্ট তারও একটু ভাগ না নিযে উপায় কী { গায়ের সমবয়সি ছেলেদের সঙ্গে পাঁচুর ঘনিষ্ঠতার প্রবল জোয়ার-ভাটা ঘটে থাকে। শহরে থাকার সময় দূরত্ব আসে, লম্বা ছুটিতে গাঁয়ে এলে প্রথম কিছুদিন অসুবিধার পর ধীবে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তবে শেষ পর্যন্ত খানিকটা ব্যবধান থেকেই যায়। একেবারে কেঁচেগণ্ডুষ করার সাধ্য পাঁচুর আর নেই। তাদের সমাজের আরও দু-চারটি ছেলে স্কুলে পড়েছে, দুবছর আগে রাধানাথ ম্যাট্রিকও পাস করেছে। স্কুলের বিদ্যার যে মানে নেই, নিছক ফাকি, ওবা তার প্রমাণ। গাঁয়ে সমাজে পরিবারে নিজেদের ঠাঁই করে নিতে সব বিদ্যা স্রেফ ভুলে মেরে দিয়ে বসে আছে, কোনো কাজেই লাগে না। একটা অকাজে লাগে, সেটা অহমিকা,-আমার পেটে বিদ্যা আছে, আমি স্কুলে পড়েছি। ! চিঠিপত্ৰ লেখার কাজ পর্যন্ত হয় না। ওদের দিয়ে, চৰ্চা নেই, ভয় পায়, ভুল হবে, ফাকি ধরা পড়ে যাবে ! রাজেন ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছিল, তার বাবা চিঠি লেখাতে আসে। পাচুকে পয়সা দিয়ে। পাঁচুও হয়তো ওদের মতো হত। কিন্তু তার অন্য জগতের ছোঁয়াচ লেগেছে। শুধুই সে বিদ্যা লাভ করেনি। এবার পাঁচুর বিদ্যালাভের কাজ থেকে ছুটিটা সুদীর্ঘ হয়তো বা চিরদিনের জন্যই। নিজের অজান্তে নিজেকে কেন্দ্র করে আটুলিগার চাষাভুসো ছেলেদের একটা দল পাচু গড়ে তুলছিল। এ রকম একটা সংগঠন গড়ার কথা সে ভাবেনি, সংগঠন যে গড়ে উঠেছে নিজে সে এটা টেরও পায়নি, মন তার ছিল অন্যদিকে। হাটে ঘাটে মাঠে এই সব ছেলেদের এর ওর তার সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখা হয়, ইয়ার্কি ফাজলামি চলে, হাসাহসি ঝগড়াঝাটি রাগারগি হয়,--দেশের কথা ওঠে। দেশের কথাটা উঠবেই। যেমন, রাজেনের সঙ্গে দেখা হয়েছে গোয়ালপাড়ায়। রাজেন এসেছে বাছুর নিতে, তাদের গোবুন্টার বাছুর গেছে মরে, দুধ দুইতে বাছুর লাগে। নিজের বাছুর পরের বাছুর সোনা বোঝে না,