পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র ষষ্ঠ খণ্ড.pdf/৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ክrክr মানিক রচনাসমগ্ৰ চালু নেই, অন্যদিন বিশ্বম্ভর নাইতে যায় রান্না শেষ করে। জুরভাব হলে বোধ হয় চান করাটা নিয়ম উড়িয়াদের। নেয়ে আসার পর বেশ চাঙ্গা দেখায় বিশ্বম্ভরকে। অন্যদিনের চেয়ে বেশি উৎসাহের সঙ্গে সে কাজে লেগে যায়। কেমন যেন আনমনা খুশি খুশি ভাব তার। ডালে কাঁটা দিতে দিতে গুণ গুণ করে গান গাইতেও শোনে পঙ্কজিনী, “নটবরো” কথাটা কানে আসে অনেকবার। তার তামাটে মুখখানা একটু যেন সুশ্ৰীই মনে হয় আজ পঙ্কজিনীর। উড়িয়া ঠাকুর, সে তো একটা রান্না করা নোংরা জীব, পাজি আর বজাত, চোর আর কামুক। সে যেন নিজেকে বাতিল করে খানিকটা মানুষ হয়ে উঠতে চাইছে। পঙ্কজিনীর বিচারেও ! সারা দুপুর পড়ে পড়ে ঘুমায় বিশ্বম্ভর। বিকালে দিনের ঘুমে থমথম করে তার মুখ, কিন্তু একটু চঞ্চল, উৎসুক মনে হয় তাকে। কিছু বুঝতে উঠতে পারে না। পঙ্কজিনী। তিন বছর আছে লোকটা, এমন ভাব কখনও সে দেখেনি। তার। কেবল গোড়ার দিকে দেশ থেকে সবে এসে যখন কাজে ঢোকে রান্নার বিদ্যায় চরম আনাড়িত্ব নিয়ে, তখন কিছুদিন এ রকম ছটফটানি ছিল। দেশের জন্য মন কেমন করত নিশ্চয়। দেশে যাবার মতলব করেছে নাকি ? সে বার দেশ থেকে এসে ছটফট করেছিল মনমরা হয়ে, এ বার দেশে যাবার ছটফটানিতে এমন স্মৃতির ভাব ? ছুটি চাইলে দিতেই হবে ছুটি, তিন বছর একটানা কাজ করে আসছে। লম্বা ছুটিই দিতে হবে। তবেই সেরেছে - প্ৰথমে ভাবে পঙ্কজিনী। তারপর জোর করে দুভাবনাটা ঠেলে দিয়ে ভাবে, তা হােক। তারা নয় কষ্ট করে নিজেরাই রাঁধবে। পনেরো দিন, এক মাস। আহা, দেশে আপনজনেরা আছে, তিন বছর বেচারি তাদের মুখ দেখেনি। বিয়ে থা করার সাধ হয়েছে হয়তো। দেশে টাকা পাঠাতে হয়, নিজে কত কষ্ট করে থেকে কিছু কিছু করে টাকা জমিয়েছে, যাতায়াতের খরচটা পর্যন্ত বাঁচাবার জন্য তিন বছর দেশে যাবার কথা মুখে আনেনি। আহা, এই জোয়ান বয়স, এখন না করলে কবে আর বিয়ে করবে, ঘরসংসার পাতবে।। নাঃ, চাওয়ামাত্র পঙ্কজিনী ওকে ছুটি দেবে, দেড়মাস দুমাসের ছুটি দেবে পুরো মাইনে সুন্ধু, আগাম দেবে মাইনেটা। বিয়ে করে বউয়ের সাথে কাটিযে আসুক কিছুদিন। উড়িয়া বলে কি মানুষ নয় লোকটা ? তিন বছর পরে আজ প্রথম এ সব কথা ভাবে পঙ্কজিনী ! তাকে সন্দেহ করা যায় না। তবু তাকে বাজারে পাঠিয়ে তাব ঘুপচি ঘরটা একবার খুজে দেখে আসতে গিয়েছিল পঙ্কজিনী। চোরাই জিনিস কিছু খুঁজে পায়নি, কিন্তু বিশ্বস্তুরের ভাঙা টিনের সুটকেসটিতে আবিষ্কার করেছিল একখানা নতুন তাঁতের শাড়ি, সস্তা এবং একটু জ্যালিজেলে কিন্তু রঙিন। পঙ্কজিনী মুচকে হেসেছিল। দুপুরে মেঘ করে আসে আকাশে।। গুমোটর ঘামে যেন নিজের গা থেকেই পচা ফুলের গন্ধ মেলে। মনটা অস্থির অস্থির করে পঙ্কজিনীর, কেমন একটা কষ্টকর বিষাদ ঘনিয়ে আসে। ছুটির দিন হলে, কেদার বাড়ি থাকলে, আজ হয়তো তাকে একটু আদর করত। মাঝে মাঝে করে। ঘরে মন টেকে না, পঙ্কজিনী ছাতে যায়। আলসেয় ভর দিয়ে তাকিয়ে থাকে বস্তির গা ঘোষা দুটি বাড়ির দিকে। মাঝে মাঝে এ সময় একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ওঠে দুবাড়ির ছাতে, কয়েক হাত তফাতে দাঁড়িয়ে দু-চারমিনিট কথা বলেই চট করে নেমে যায়। আজ ওরা ছাতে উঠবে কিনা কে জানে। বস্তির খোড়া মেয়েটা ঘুটের টুকরি মাথায় নিয়ে আসছে গলি দিয়ে। ওর ঘুটেগুলি ছোটাে ছোটাে বিশ্ৰী, দামও বেশি চায়, কোনোদিন ওর কাছে ঘুটে রাখে না। পঙ্কজিনী। তাই, বিশ্বম্ভরের ব্যাপার দেখে ছাতে দাঁড়িয়ে থ মেরে যায় পঙ্কজিনী। দূরের থেকে ঘুটে চাই গো ডাক শূনেই বিশ্বস্তুর যেন লাফিয়ে উঠে গিয়ে দরজা খোলে খিড়কির, এই ডাক শোনার জন্য যেন কান পেতে ছিল। একেবারে সে ভেতরে নিয়ে আসে মেয়েটাকে। আগে দুবার বিশ্বম্ভর ঘুটের পয়সা চেয়ে নিয়েছে