পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র সপ্তম খণ্ড.pdf/১১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SSN মানিক রচনাসমগ্ৰ পুরানো ছেড়া আর ময়লা হােক, ভোলার মার পরনের কাপড়খানা তাঁতের এবং রঙিন। নতুন হলে আশাও নিশ্চয় পরতে আপত্তি করত না। এই কাপড়খানাই সব সময় ভোলার মারা পরনে দেখা যায়। সরকারদের মস্ত বাগানটার প্রাচীরের পাশ দিয়ে তফাতে ফাকা জমিতে হোগলার যে খেলাঘরগুলি উঠেছে, তারই একটাতে তারা থাকে। বিয়ের যুগি মেয়ে আছে একটি। ওই হতভাগিই এখন নাকি সবার বড়ো দুৰ্ভাবনা-ভোলার বাপ-মার। ভোলার মা কঁদুনি গায় না। দুৰ্দশার সে স্তর তারা পার হয়ে গেছে। বোধ হয়। সেই জন্যই নানা কথা জিজ্ঞাসা করার পরেও দাম দেবার সময। আশা যখন অনায়াসে বলে, তোমার ডিমের দাম বেশি। ভোলার মা ! তখন ভোলার মা রাগও করে না, নিজের দূরদৃষ্টিকে শাপও দেয় না, সোজাসুজি স্পষ্ট ভাষায় বলে, কী কথা কন ? এক পয়সা বেশি না ! বাজার দরে বেচি। উনি পাইকারি দিবে। কিনা আনেন, খুচরা দরে বেচনের লাভীটুকু থাকে। সাধনাকে সে জিজ্ঞাসা করে, আপনে নিবেন না ? সাধনা মাথা নাড়ে। তার গলার দিকে চেয়েই যেন ভোলার মাও মাথা হেলিযে তার ডিম কেনার অক্ষমতায় সায় দেয়, না কেনাকে সমর্থন করে ! গলার কাছটা শিরশির করে সাধনার। বিছাহারের শূন্যতা যেন বিছার মতো হাঁটছে। রাখাল পাড়ার একটি স্কুলের ছাত্রকে সকালে সাড়ে সাতটা পৰ্যন্ত পড়ায়। পড়িয়ে সটান চলে যায় মাইলখানেক দূরে আরেকটি কলেজের ছাত্রকে পড়াতে। বাড়ি ফিরে নেয়ে খেয়ে বার হয়। সারাদিন ঘোরে চাকরি এবং রোজগারের চেষ্টায়-আরও কীসের ধান্ধায় সাধনা জানে না। সন্ধ্যায় রাখাল একটি ছাত্রীকে পড়ায়-দুঘণ্টা। এই টিশনিটাই তাকে বঁচিয়ে রেখেছে। মাসাস্তে কটা টাকা পাওয়া যায় বলেই নয়, রোজ এখানে সে চা আর কিছু খাবার পায়-অন্তত দুখানা বিস্কুট।। আশ্চর্য যোগাযোগ । সারাদিনের শ্রান্তি বয়ে নিযে গিয়ে শুধু ওই চা খাবারটুকু পেয়ে সে চাঙ্গা হয়ে ওঠে, প্রভাকে ভালো করে পড়াতে পারে বলে প্রভারাও খুশি হয়ে তাকে রোজ চা-জলখাবার দেয়। যেদিন বাসে ফেরে রাত প্ৰায় সাড়ে নটা হয়। হেঁটে ফিরলে দশটা বেজে যায। হেঁটে ফিরলে সাধনা বলে, ছটা পয়সা বাঁচালে। দেহের ক্ষয়টা হিসাব করেছ ? যে রোগটা হবে দুশো টাকায় সারাতে পারবে ? রাখাল মুখ বঁকায়।--রোগ হলে আর সারাবে কে ? জ্যোৎস্নারাত, বেড়াতে বেড়াতে চলে এলাম। ছ। পয়সায় সিগারেট কিনিলাম তিনটে । সাধনা চুপ করে থাকে। গা যখন জুলে যায়। তখন কথা কওয়া মানেই ঝগড়া করা। তিনটি সিগারেট কিনতে হবে, তার অজুহাত হল জ্যোৎস্নারাত। সিগারেট কেনার দায়ে রাখাল হেঁটে আসে। নি, জ্যোৎস্নারাত দেখে শ্ৰান্তক্লাস্ত অভুক্ত দেহটাকে মনের আনন্দে দু মাইল পথ হাঁটিয়েছে। খেয়ে উঠে সাধনা মই দিয়ে ছেলেকে ঘুম পাড়ায়। বড়ো হয়েছে, দসু্যর মতো আধ-শূকনো মই টানে ছেলেটা, বন্ধুক্ষণ মই দুটি তার টনাটনিয়ে থাকে। পোয়াটেক গোরুর দুধ না বাড়ালে আর চলে না। হঠাৎ তাই সখেদে বলে, হারটার ব্যবস্থা করবে না ? খালি গলায় থাকতে পারব না। আমি। নতুন তো চাইছি না, সে আশা ছেড়ে দিয়েছি। সোনা আছে, শুধু মজুরি দিয়ে গড়িয়ে দেবে, তাও জুটবে না। কপালে ? দশজনের কাছে আমি মুখ দেখাতে পারি না !