পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র সপ্তম খণ্ড.pdf/১৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S8S মানিক রচনাসমগ্ৰ জুরের মতো হয়েছে একটু। তবে এলেন কেন ? রাখাল মনে মনে বলে, এলাম কেন ? না এলে তোমরা যে রাগ করবে ! মুখে বলে, খানিকক্ষণ পড়িয়ে যাই। একেবারে ফাঁকি দিলে চলবে কেন ? প্রভা মুখ ভার করে বলে, ভাগ্যে আমি আপনাকে মাইনে দিই না-টােকাটা বাবার। নইলে সত্যি একবার চাঁটতে হত। মুখের ওপর এমন করে কাউকে ধিক্কার দিতে আছে ? ধিক্কার কীসের ? প্রভা একটু হেসে বলে, আমরা জন্ম জন্ম দাসীর জাত, মেয়েমানুষ। ধিক্কার দেবার এ কৌশল আমরা জানি। জুর গায়ে রাঁধতে গিয়ে আমরা যখন বলি, না রোধে উপায় কী, সবাই খাবে কীতখন সেটা পুরুষদের ধিক্কার দিয়েই বলি। তোমাকে রাঁধতে হয় নাকি ? বলেই রাখাল গুম খেয়ে যায়। আগের বার ধিক্কার না দিয়ে থাকলেও এ কথাটা রীতিমতো খোচা দেওয়া হয়ে গেছে। বড়োলোকের মেয়েকে এ প্রশ্ন করার একটাই মানে হয। মুখখানা সত্যই স্নান হয়ে যায় প্রভার। এত উজ্জ্বল তার গায়ের বং যে মুখে একটু মেঘ ঘনালেই মনে হয় দুৰ্যোগ ঘনিয়েছে। রাখাল আবার বলে, কিছু মনে কোরো না প্রভা। প্ৰভা বলে, কেন মনে করব না ? আমার বাবা কি খুব বেশি বড়োলোক ? বারোশো টাকা মাইনে পান। আজকের দিনে বারোশো টাকা পেলে কেউ বড়োলোক হয় ? টাকাব্য ভাবনায় রাত্রে বাবার ঘুম হয় না তা জানেন ? রাখাল বিব্রত হয়ে বলে, আমি এমনি বলেছি কথাটা। একটা রাঁধুনি তো আছে, তোমরা না রাঁধলেও চলে, এর বেশি কিছুই বলতে চাইনি। প্রভা। কিন্তু এত সহজে তাকে রেহাই দিতে রাজি নয়। সে বঁাঝের সঙ্গেই বলে, তা না চাইলেও এটা সত্যি যে আমাদের সম্পর্কে আপনাদেব অনেক ভুল ধারণা আছে। রাঁধতে হয় না বলেই কি আমি স্বাধীন ? যাদের রাঁধতে হয়, আমিও তাদেরই দলের। খানিকটা আরামে থাকি, এইটুকু তফাত । রাখাল আর কথা কয় না। এবার কিছু বলা মানেই ছাত্রীর সঙ্গে তর্কে নামা। প্ৰভা নতুন থিয়োরি শিখেছে, সবটাই অতি রোমাঞ্চকর। তফাত থাকলেও যে রাঁধুনি রাখে পয়সা দিয়ে সে সমান হয়ে গিয়েছে দুবেলা যাকে পয়সার জন্য পরের বাড়ি হাঁড়ি ঠেলতে হয় তার সঙ্গে---এই অতি মনোরম সিদ্ধান্ত সে আবিষ্কার করেছে একেবারে অন্যস্তরের অন্য এক সত্য থেকে। বড়ো ধনী ছাড়া বড়ো ধনিকের শাসনে সবাই এ দেশে নিপীড়িত। দুর্মুল্য খোলা বাজার আর চোরাবাজার শুধু তার বাবার মতাে বারোশো টাকা আয়ের মানুষকে কেন আয যাদের আরও অনেক বেশি তাদেরও জোরে আঘাত করেছে-মাঝারি ব্যবসায়ীরা পর্যস্ত আজ বেসামাল হবার উপক্ৰম। ধনিক শাসনের অবসান শুধু গরিবের নয়, এদেরও স্বার্থ। এ পর্যন্ত অবশ্যই সত্য কথাটা। কিন্তু এই সূত্র ধরেই প্ৰভা যখন তাদের সঙ্গে সাধনাদের টানাটানি তাদের তফাতটা নিছক আরামে থাকা না থাকায় দাঁড় করায় তখন গা জ্বালা করারই কথা । আরামের অভাব আর আসল অভাব প্রভার কাছে এক ।