পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র সপ্তম খণ্ড.pdf/১৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

እ8br মানিক রচনাসমগ্র সংসারের খরচ থেকে একটি দুটি করে বাসন্তী টাকাগুলি জমিয়েছে। বাসন্তী নিজে এসে গুনে দিয়ে গিয়েছিল নেটগুলি। সাধনা আরেকবার গুনে বাক্সে তুলে রেখেছিল-ট্রাঙ্কের মধ্যে তার গয়না রাখার ছোটাে বাক্সে। বাকসে যেন আঁটে না এত নোেট ! ক-ভরি সোনার বদলে একরাশি টুকরা কাগজ। প্ৰথমে তার মনে জেগেছিল একটা দ্বিধা রাখালের ভরসা না কবে কাল আবার বাসষ্ঠীর সঙ্গে দোকানে গিয়ে নিজেই কিনে আনবে নতুন হারটা ? অথবা রাখালকে টাকা দেবে কিনে \left(\5 ? রাখালকে জানানো হয়নি সে নিজেই হার বিক্রির ব্যবস্থা করেছে ! হার কেনার ব্যবস্থােটাও যদি রাখালকে না জানিয়ে করে ? যে ব্যবহারটা রাখাল জুড়েছে তার সঙ্গে তার একটা উচিত মতো জবাব দেওয়া হবে সে অত তুচ্ছ নয়, পরাধীন দাসী নয় ! বাড়াবাড়ি হবে ? হােক বাড়াবাড়ি ! তাকে নিয়ে রাজীবের মিথ্যা মতলব আন্দাজ করে। বাড়াবাড়ির চরম করেনি রাখাল ? সে কোন অত সমীহ করে চলবে তাকে ? তবু নানা সংশয় জাগে। একটা অজানা আতঙ্ক ছুয়ে ছুঁয়ে যায় প্ৰাণটা। জোর করে সে রেবার বিয়েতে যাবে, রাখাল না গেলেও একা যাবে-এই ঝগড়াটাই কোথা থেকে কীসে গিয়ে দাঁড়ায় ঠিক নেই। রাখাল এখনও তার হুকুম ফিরিয়ে নেয়নি, সেও ছাড়েনি তার জিদ। এত প্ৰচণ্ড হয়ে উঠেছে। তাদের এই বিরোধ যে এ বিষয়ে তারপর একটি কথাও হয়নি তাদের মধ্যে ! রাখাল অপেক্ষা করছে সে কী বলে কী করে দেখবার জন্য। হয়তো রাখাল আশাও করছে যে সে তার জিদ। ছেড়ে দিয়েছে তাই আর হারের কথা তুলছে না। আর এদিকে সে অপেক্ষা করছে। রাখাল নিজে থেকে তার হুকুম ফিরিয়ে নেবে, নতুন হার এনে দেবার জন্য ভাঙা হারটা চেয়ে নেবে, আরেকবার তাকে বিবেচনা করার সুযোগ দেবে যে বিয়েতে সত্যি সে যাবে কিনা। এ ব্যাপারেই কী ঘটে না ঘটে, আরও গোলমাল সৃষ্টি করা কি ঠিক হবে ? তার ভয় করে। মনে হয় নিজের দোষেই হয়তো সে নিজের সর্বনাশ করে বসবে। সবদিক দিয়ে দারুণ দুঃসময়, আর কােজ নেই। অশান্তি বাড়িয়ে। এই ভয়টাই আবার যেন তাকে ঘা মেরে কঠিন করে দেয়। এই ভয় যেন তাকে বলে দেয, তোমার মতো নিরূপায় অসহায় কেউ নেই, রাখাল ছাড়া তোমার আর গতি নেই, তোমার সাধা নেই রাখালের বিরুদ্ধে যাবার। রাখালের ইচ্ছা অনিচ্ছা খুশি অখুশিই তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছা খুশি অখুশি। রাখাল যদি রাখে। তবেই তোমার মান থাকে। রাখাল খেতে পরতে না দিলে তুমি খেতে পাবে না, ন্যাংটো হয়ে থাকবে, খেয়াল নেই তোমার ? আগে খেয়াল ছিল না। সত্যই, নিজের জিদ বজায় রাখতে গেলে রাখাল শেষ পর্যন্ত কী করবে: এই ভয় এবার হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিয়েছে। একেবারে যেন ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছে নিজের সম্পর্কে তার মর্যাদাবোধ, এ সংসারে তার অধিকারবোধ মনুষ্যত্ববোধ । এই তবে তার আসল সম্পর্ক রাখালের সঙ্গে, সংসারের এইখানে তার আসল স্থান ? ও বাড়ির সুধা নিয়মিতভাবে মারধোর লাথি-বঁটা পায় স্বামীর কাছে। সুধার সঙ্গে তার আসলে কোনো পার্থক্য নেই। রাখাল যে তাকে মারধোর করে না সেটা নিছক রাখালের বুচি । এর মধ্যে তার কোনো বাহাদুরি নেই। তখন আবার বিগড়ে যায়। সাধনার মন। এক উগ্ৰ প্ৰচণ্ড বিদ্রোহ জাগে তার মধ্যে। হােক তার সর্বনাশ, ভেঙে চুরমার হয়ে যাক তার সংসাব, ঘুচে যাক স্বামীর কাছে তার সব আশাভরসা-নত সে হবে না কিছুতেই।