পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র সপ্তম খণ্ড.pdf/১৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

> 28 মানিক রচনাসমগ্ৰ কী বিড়ম্বনা জীবনে ! সাধনাকে অমানুষ মনে হয় রাখালের। গভীর বিতৃষ্ণার সঙ্গে মনে হয় একটা সচল মাংসপিণ্ড যেন ক্ষুদ্র স্বার্থপর এক টুকরো প্ৰাণ বসিয়ে জীবন্ত মানুষটা তৈরি হয়েছে। হয়তো কোনো দোষ নেই। সাধনার। সংসার তাকে গড়ে তুলেছে এমনিভাবে, ছোটো করে দিয়েছে তার মনটাকে। হয়তো প্ৰাণ দিয়ে চেষ্টা করলে খানিকটা সংশোধন সে করেও নিতে পারত তাকে । কিন্তু সে জন্য তো বাতিল হয়ে যায় না। এ সত্যটা যে সে অতি নিচুস্তরের ঘূণ্য মানুষ। সেই সাধনা, যার হাসি দেখে তার প্রাণ জুড়িয়ে যেত। যার সরল নির্ভর, শান্ত মধুর প্রকৃতি আর কেরানির সংসারের স্বল্প আয়োজন নিয়েই সংসার করার আনন্দে মশগুল হয়ে থাকার ক্ষমতা দেখে মনে হত, কত সৌভাগ্য তার যে এমন বউ পেয়েছে ! আজ কী স্পষ্ট হযেই ধরা পড়েছে তার ক্ষুদ্র সংকীর্ণ হৃদয় আর অবুঝ একগুয়ে মনের পরিচয়। এ পরিচয় কী করে এতদিন তার কাছে গোপন ছিল ভাবলেও বিস্ময় বোধ হয় । হয়তো তাই হবে। এ সব ছোটাে হৃদয় ছোটাে মনের মানুষ অল্প পেয়েই খুশিতে গদগদ হয়ে যায়, নিজেকে ধন্য মনে করে। তখন হয়ে থাকে একেবারে অন্যরকম মানুষ ! আবার সেটুকুর অভাব ঘটলেই একেবারে বিগড়ে যায়। এ সব মানুষ। একেবারে বিপরীত বৃপটা প্ৰকাশ হয়ে পড়ে। জীবন খালি হয়ে গেল, শরীরে খালি হয়ে এল জীবনী শক্তি, সোনার হারের অভাবে খালি গলার শোকেই সে আকুল ! রেবার বিয়েতে যাওয়ার ছলে সে গড়িযে নিতে চায় নতুন হার ! ক-দিন জগৎ সংসার তুচ্ছ হয়ে গেছে তার কাছে, ভাতের হাঁড়ির মতো হয়ে আছে তব মুখ, অস্থির উন্মনা অস্বাভাবিক হয়ে গেছে তার কথাবার্তা চালচলন ! তার নিজের বা তার ছেলের বা স্বামীর একটা অসুখ হলে চিকিৎসা হবে না জানে, অথচ নতুন হার গলায় দিয়ে সেজোগুজে বিয়ে বাড়িতে গিয়ে কনেকে নিজের কানপাশা উপহার দিতে পারবে না। বলে, দশজন আত্মীয়বন্ধুর কাছে মিথ্যা সম্মান মিথ্যা সমাদর পাবে না বলে, পাগল হয়ে যেতে বসেছে ! an তাকে আর তার রকম-সকম দেখে কে না বুঝবে যে এটা শুধু তার একটা জোরালো সাধ নয়, সাধটা না মিটলে সে শুধু গভীর মনোবেদনা পাবে না-এটা তার জীবনের চরম কামনায় দাঁড়িয়ে গেছে, এ কামনা না মিটলে হয়তো সে সত্যই পাগল হয়ে যাবে। ভাবতেও ঘূণা বোধ হয় রাখালের। নিরূপায বিদ্বেযে নিশ্বাস তার আটকে আসতে চায়। নতুন হার তাকে এনে দিতেই হবে। নিয়েও যেতে হবে রেবাব বিয়েতে। তাছাড়া উপায় নেই। এই সামান্য ব্যাপারে মাথা বিগড়ে দেওয়া যেতে পারে না। সাধনার। যত প্রতিক্রিয়া হবে সব ভোগ করতে হবে তো তাকেই। ছেলেটার কথাও তো ভাবতে হবে। রাখালকে সাধনার পাষণ্ড মনে হয়। রক্তমাংসের মানুষ নয়, অস্বাভাবিক অমানুষিক কিছু দিয়ে গড়া। চোখ ফেটে তার জল আসতে চায়। যে রাখাল এত বড়ো বড়ো কথা বলত, এত ছোটো তার মন ? পাশাপাশি শুয়েও সে ভুলতে পারে না তাদের কলহ হয়েছে ? পাশাপাশি শুয়ে নীরব উপেক্ষায় তাকে কাবু করে কলহে জয়ী হতে চায় ? এত সে নীচ ? সাধনার সহ্য হয় না। সে উঠে গিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। রাখাল বলে, কী হল ?