পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র সপ্তম খণ্ড.pdf/১৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

>bro মানিক রচনাসমগ্ৰ সর্বাঙ্গে গয়না আঁটা থাকত বাসন্তীর, দামি দামি রঙিন শাড়িই শুধু সে পরত। চেয়ে দেখেই সুখে আনন্দে থই থই করত রাজীবের মন। উঠতে বসতে বাসন্তীর ছিল ঝগড়া আর নালিশ, কথা যেন বলত শুধুই মুখ ঝামটা দিয়ে। কিন্তু ওটাই ছিল বাসন্তীর আদর সোহাগ আহ্বাদ আবদারেব বিশেষ ধরন, ঝগড়াটে হয়ে থেকেই সে একেবারে জমিয়ে দিত রসিয়ে দিত জীবনটাকে। পাড়ার মানুষ বলে কুঁদুলে বউ-তারা কী জানবে সে কেমন কেঁদল, তারা কী বুঝবে রাজীব কেন নিরীহ গোবেচারি সেজে থাকত ! তারা তো হিসাব রাখত না বাসন্তী কখন ঝগড়া করে, কখন করে না। দরকারি কথা বলার সময়, রাজীবের শ্রাস্ত ক্লান্ত হয়ে থাকার সময়, নিরালায় আদর সোহাগের সময় ওই ঝগড়াটে মানুষটাই আবার কেমন অন্যরকম মানুষ হয়ে যেত, রাজীব ছাড়া কে তা জানবে ! সেই বাসন্তীর গায়ে আজ গয়না নেই-গলায় একটি হার আর হাতে তিনগাছা করে চুড়ি। সেই বাসন্তী আজ ঝগড়া করতে ভুলে গেছে। জীবন-যাত্রার আকস্মিক বিপর্যয়ে কেমন থাতোমতো খেয়ে গেছে, শাস্ত নিজীবী হয়ে গেছে। রাজীবের জন্য গভীর সহানুভূতিতে যান চব্বিশ ঘণ্টা আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। কলহ করা নেই, মান অভিমান নেই, লীলা-চাপল্য নেই। দামি শাড়িগুলি আজও পরে। অনেক শাড়ি ব্লাউজ জমানো আছে, বহুদিন চলবে। একই জামাকাপড়ে জড়ানো সেই একই মানুষ, তার সেই একই রূপ-যৌবন, তবু রাজীব তার দিকে তাকিয়ে আগেকার পুলক অনুভব করতে পারে না। মনে হয়, তার বাসন্তী আর নেই। বাসন্তী বদলে গেছে। বদলে গেছে, কিন্তু তিতেও হয়নি, টকেও যায়নি। মুখ গোমড়া করে থাকে না বাসন্তী, হাহুতাশ করে না, কখনও তাকে বিরূপ দেখা যায় না। রাজীবের উপর। কেঁদেল করা লীলাখেলার উদামতাটুকু বাদ দিলে সে ধীর শান্ত হয়েছে। সত্য কথা বলতে কী, সে জন্য আকর্ষণ যে তার কমেছে রাজীবের কাছে মােটেই না নয়। আজকাল বরং নতুন ভাবে বেশি করে টানছে বাসন্তী-দাসী রাঁধুনির মতো তাকে খাটতে দেখে দিনরাত তাকে সোহাগে আদরে ডুবিয়ে রাখবার সাধটা অদম্য হয়ে উঠেছে ! এত ভালো লাগছে, নতুন রকম ভালো লাগছে, তাকে আদর করতে ! কিন্তু তবু রাজীব আগের বাসষ্ঠীকেই ফিরে চায়। নাঃ, উঠে পড়ে লাগতে হবে। আবার, ব্যাবসাটা গড়ে তুলতে হবে। লাখপতি হতে চায় না। রাজীব, প্রাসাদ চায় না মোটর গাড়ি চায় না-শুধু আগের দিনগুলি ফিরিয়ে আনতে চায়। বাসন্তীর গায়ে গয়না উঠবে, সতেজ জীবন্ত হয়ে উঠে আবার নানা বায়না ধরবে বাসন্তী, ঝংকার দিয়ে ঝগড়ার ঢংয়ে আবার সে প্ৰেমালাপ করবে। তার সঙ্গে ! রাখাল তার মনের কথা জানলে নিশ্চয় মনে মনে বলত, এই নাকি প্ৰেম তোমার কাছে ? টাকায় যা খাড়া ছিল, টাকার অভাবে যা ফুরিয়ে গেছে, আবার টাকা হলেই যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে ? রাজীব এ সব বোঝে না। রাখালের কাছে টাকা শুধু টাকাই, রাজীবের কাছে তা নয়। টাকা ছাড়া যদি মানুষ বঁাচে না। আর সেটা যদি সস্তা না করে দেয় বঁচাকে, টাকা ছাড়া ভালোবাসা না জমলে সেটা খাপছাড়া হয় কীসে, প্রেমকে সেটা ছোটাে করে দেয় কোন যুক্তিতে ? সব দিক যার টানাটানি তার জীবনে আনন্দ আসবে কোথা থেকে ? দরকার মতো যার টাকা নেই তার আবার প্ৰেম-ভালোবাসা, তার আবার বেঁচে থাকার সুখ ! বিড়ির পাতা শুখা তামাকের বস্তায় ভরা ছোটাে লম্বাটে ঘরখানায় বসে কেনাবেচার অবসরে দুজনের মধ্যে যে এ রকম দার্শনিক কথা একেবারেই হয় না তা নয়।