পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র সপ্তম খণ্ড.pdf/১৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সোনার চেয়ে দামি Stry সব মানুষেরই দর্শন আছে, দার্শনিক আলোচনা ছাড়া কোনোও মানুসের চলে না। জীবনদর্শন ছাড়া মানুষের জীবন নেই কোনো স্তরের। হয়তো সেটা পণ্ডিতের দর্শন নয়, ছাঁকা তত্ত্বের জটিল দর্শন নয়। নিজেরই জ্ঞান বুদ্ধি অভিজ্ঞতা শিক্ষাদীক্ষা সংস্কারের দর্শন, নিজের জীবন আর জগৎটার একটা নিজের বোধগম্য মানে খাড়া করার দর্শন। রাজীব হয়তো ওই কথাই বলে, টাকা ছাড়া সত্যি সুখ নেই দাদা ! রাখাল হেসে বলে, টাকার সুখ কি আসল সুখ ? সুখের আবার আসল নকল আছে নাকি ? সুখ হল সুখ। অসুখ হল অসুখ ! ও ভাবে ধরলে কথাটা তাই বটে, আমি বলছিলাম মানুষের মনে করার কথা। আসলে যা সুখ নয় সেটাকেও মানুষ সুখ ভেবে নেয়। ওটাকেই বলছিলাম নকল সুখ। আপনি বলছেন টাকার কথা। টাকা থাকলেই কি সুখ হয় ? তাই কি হয় ? এককঁাড়ি টাকা হলে কি এককঁড়ি সুখ হয় ? টাকা হলেও সুখ একদম নাও হতে পারে। তবে কিনা টাকা। নইলেও আবার সুখ কিছুতে হবার নয়, সুখের জন্যও টাকাটি চাই। টাকা বাদ দিলে উপোস দেয সুখ, সে হল মশাই সাধুসন্নেসীর সুখ। আর আপনার আমার সুখ ? এই ভাতকাপড় আরাম-বিরাম শাস্তি— তবেই দেখুন, আপনি সব জড়িয়ে দিচ্ছেন। বাঁচাব জন্য ভাত কাপড় চাই, আরও কতগুলি ব্যবস্থা চাই। তার মানেই টাকা চাই, টাকা দিয়ে এ সব ব্যবস্থা হয়। সুখ-শাস্তি এ সব তার পরের কথা। আগে বঁচা চাই ঠিক, নইলে সুখ-শাস্তি কীসের ? কিন্তু বাঁচবার ব্যবস্থা হলেই কি সুখ-শাস্তি ব্যবস্থা হয় ? সে হল আলাদা ব্যবস্থা। টাকা চাই স্রেফ বাচার জন্য, টাকায় সুখ হয় না। রাজীব দমে গিয়ে দাড়িতে হাত বুলায়, তার চোখ মিটমিট করে। এবার সে ধাধায় পড়ে গেছে ! রাখাল আবার বলে, সুখ মানেই হল আনন্দ। আনন্দ মানুষকে সৃষ্টি করতে হয়। টাকা দিয়ে কেনার জিনিস নব্য ওটা। টাকার অভাবে কী হয ? বাঁচার কষ্ট-জীবনে ওই আনন্দ সৃষ্টির ক্ষমতা নষ্ট করে দেয় মানুষের। এই হিসেবে যদি বলেন টাকা ছাড়া সুখ হয না, তাহলে অবশ্য কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এই হিসেবটুকু ভুললে চলবে না, সুখ আপনাকে সৃষ্টি করতে হবে। রাজীব বলে, কিন্তু রাখালবাবু, আসলেই যে খটকা বাধছে। কোনো অভাব নেই, অশান্তি নেই, রোগ-বালাই নেই-পাঁচজনকে নিয়ে এ রকম বঁচোটাই তো সুখের, তাতেই তো আনন্দ মানুষের। আনন্দ আবার ভিন্ন করে সৃষ্টি করতে হয়, তার মানে তো বুঝলাম না মশাই! বিশেষ আনন্দ হয়, বড়োদরের আনন্দ হয়, সে আলাদা কথা। তার জন্য সাধন-ভজন যোগ-টোগ দরকার হয়। কিন্তু সাধারণ সংসারী মানুষের সাধারণ আনন্দ, দুঃখ কষ্ট রোগ ব্যারাম তা থাকলে সে তো আপনা থেকেই জুটবে। জুটবে ? হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবেন তবু সুখশাস্তি আনন্দ জুটবে ? অভাব নেই। আপনার একার, যে পাঁচজনকে নিয়ে সংসার, বাইরে যে দশজনের সঙ্গে কারবার, তাদের তো আছে। বাইরের মানুষ কেন, ঘরের মানুষের সঙ্গে কত বিষয়ে আপনার স্বার্থের মিল নেই। স্বামী-স্ত্রীর পর্যন্ত সব স্বার্থ এক নয়। পাঁচজনের সঙ্গে সামলো-সুমলে সামঞ্জস্য করে আপনাকে চলতে হবে, পাঁচজনকে সুখী হবে—আরও কত কী করে তবে না। খানিকটা আনন্দ জুটবে আপনার। এবার রাজীব খুশি হয়ে ওঠে। হাঁহী, এটা ঠিক বলেছেন ভাই। একেই বলছেন সৃষ্টি করা ? তা হলে তো ঠিক আছে কথাটা ! এটাকেই তো আমি বঁচা বলছিলাম ! নইলে কলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে বঁচোটা কী আর বাঁচা !