পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র সপ্তম খণ্ড.pdf/২৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানিক রচনাসমগ্র 08ܘܓ তার সম্পর্কে অদ্ভুত বৈরাগ্য আর গাঢ় ঘুম ছাড়াও আরেকটা গুরুতর ব্যাপার ঘটেছে। মাঝে মাঝে রাত্রের খাওয়াটা বাদ যাচ্ছে রাখালের ! আজ পর্যন্ত এমন অদ্ভুত ব্যাপার আর কখনও ঘটেনি। বাইরে নেমস্তন্ন থাকলেই কেবল রাত্রে বাড়িতে খাওয়াটা বাদ যেত রাখালের, তার জন্য রায়াই হত না। আগে থেকে কিছু জানা নেই, হঠাৎ কোনো যোগাযোগ ঘটে রাত্রির ভোজনটা জুটে গেল-এটা ঘটত কদাচিৎ। এবারকার মনস্তরের পনেরো-ষোলোটা দিনের মধ্যে এটা ঘটেছে সাতবার। গোনা গাঁথা হিসাব আছে সাধনার। রান্না হয়েছে তার জন্য। অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরে সে জানিয়েছে যে খাবে না। আজও ফিরে এসে জামা-কাপড় ছাড়তে ছাড়তে সে বলে, আমি খেযে এসেছি। ঘুমে আর শ্রাস্তিতে তার চুলু ঢুলু চোখ দেখে সাধনার মনটা হঠাৎ কেমন করে ওঠে, মমতার যেন বন্যা বয়ে যায় তার হ্রদয়ে। প্রমীলার কথা শুনে আজ সে মিটমাটের আশা পোষণ করছিল। কিনা, বোধ হয় সেই জন্য ! সব ভুলে যায় সাধনা। হাসিমুখে বলে, জানো রোববারের সভায় আমাকেও যেতে বলেছে। প্রমীলা বসু নিজে বলতে বলতে একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়ায় রাখালের। রাখাল মুখ ফিরিযে নেয়। খানিকটা তফাতে সরে যায় । পক্ষাঘাতে সর্বাঙ্গ যেন অবশ হয়ে যায় সাধনার। যেভাবে দোল খায় পায়ের নীচের পৃথিবী, কী করে যে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে ভেবে পায় না। তবু জোর করে সাধনা নিজের মনকে বলে, সে নিশ্চয় ভুল করেছে ! রাখালের মুখে সে গন্ধ নয়। নিজে সে ঠিক বুঝতে পারেনি। ংবা রাখাল হয়তো কোনো ওষুধ খেয়েছে-ডাক্তারের নির্দেশমতো। কথা বন্ধ, অসুখ হলেও রাখাল তো তাকে জানাবে না। ওষুধটার জন্যই গাঢ় ঘুমও হচ্ছে রাখালের। যন্ত্রের মতো রান্নাঘরে গিয়ে বুটি নিয়ে দুখানা কোনোরকমে খায়, হেঁশেল তুলে রান্নাঘর বন্ধ করে উঠানে দাঁড়িয়ে যন্ত্রের মতোই জ্যোৎস্নায় ভাসানো আকাশের দিকেও চোখ তুলে তাকায়। তারপর ঘরে যায় । রাখালের তখন নাক ডাকছে। বুগণ ছেলেটা ক্ষীণস্বরে কঁদেছিল। তাকে উপেক্ষা করে সাধনা খাটের দিকে এগিয়ে যায়। তখনও সে ভাবছে, সন্দেহ মিটিয়ে নেব ? না, সংশয়টুকু আঁকড়ে থাকব ? কিন্তু তা তো আর হয় না। স্বামীর মুখে মদের গন্ধ পেয়ে নিজে ভুল করেছি মনে করে কতক্ষণ আর খাটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যায় ? যেন আত্মহত্যা করছে এমনিভাবে সে কুঁকে পড়ে রাখালের মুখের উপর । এতখানি প্রত্যক্ষ নির্ভুল পরীক্ষার অবশ্য কোনোই দরকার ছিল না। মশারি তুলতেই রাখালের নিশ্বাসের গন্ধ বেশ ভালোভাগেই তার নাকে গিয়েছিল। গা গুলিয়ে বমি আসে। বাইরে ছুটে গিয়ে সাধনা যা কিছু খেয়েছিল সব বমি করে ফেলে। অনভ্যস্ত পদার্থটা একটু বেশি পান করে ফেলায় রাখালেরও আজ বমি আসছিল। তার নিশ্বাসে পদার্থটার গন্ধ শূকেই সাধনা বমি করে ফেলে।