পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র সপ্তম খণ্ড.pdf/২৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানিক রচনাসমগ্ৰ ܟܠ চিৎকারের মতো যে পরীক্ষণে খটকা লাগে সত্যই কেউ চেচিয়েছে কিনা ! তারপর একদিক থেকে মিলিটারি ট্রাকের ঘর্ঘর ধ্বনি দ্রুতগতিতে চড়তে চড়তে ভেসে এসে সব শব্দের রেশ আর নিঃশব্দতা ডুবিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। হাত ধরে প্রমথকে প্রণব গলির মোড় থেকে অপর দিকের ফুটপাথে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায়। কারফিউ এলাকার গা ঘেঁষে দাঁড়ানো নিরাপদ। কিনা জানা নেই। অনেক কিছুই জানা নেই। কীসে কী হয় বোঝা অসাধ্য। কার আইন, কেই বা জানে, মানেই বা কে। গা ছমছম করছে, প্রণব। এত দূর এসে দু পা যেতে ? এই গলি তো ? দ্বিধার সঙ্গে প্রমথ সায় দেয়। এই সংশয়ের জন্যই এতক্ষণ ইতস্তত করা, হঠাৎ গলির মধ্যে ঢুকে পড়তে মন সরছে না। এমনভাবে বদলে গিয়েছে। পথটার চেহারা, এমনভাবে গা-ঢাকা দিয়েছে। চিনিয়ে দেবার চিহ্নগুলি যা স্মৃতিকে সাহায্য করতে পাবত। দর্জির একটা দোকান ছিল মনে আছে, ওই আধাপোড়া কালচে-মারা ঘরটা কি সেই দর্জির দোকান ? সারি সারি রঙিন কাপড় ব্লাউজ ফ্রক শুকোত একটা দোতলা বারান্দায়, তারই উপরে তেতলার বারান্দায় ফেলা থাকত চিক-ওই যে খা-খাঁ করছে। শূন্য বাড়িটা, মানুষ নেই, জামাকাপড় নেই, চিক নেই, জানালা দরজা এলোমেলোভাবে হাঁ করে অথবা বন্ধ হয়ে আছে, ওটা কি সেই বাড়ি ? গলিটা জনহীন। গলিতে স্রোতের মতো একটানা আনাগোনা ছিল মানুষের। প্রণব বাস্তববাদী মানুষ, বাস্তব অবস্থার অভাবনীয উদ্ভট পরিবর্তন ঘটলে বিচলিত হয়, দিশেহারা হয় না। এ ঠিকানায় ওরা না-ও থাকতে পারে ! প্রমথ একটু ইতস্তত করে বলে, না, এখানেই আছে। চিঠি পেয়েছি। মণি চিঠি লিখেছে ? আশ্চর্য তো। কদিন আগে ? চার-পাঁচদিন হবে। চার-পাঁচদিন ! প্রণব মনে মনে ঝাঝালো কৌতুক অনুভব কবে। দশ-বিশবছরের লোকজনে ভরপুর বাড়ি একবেলায় বিনা নোটিশে খালি হয়ে যাচ্ছে, প্রমথ হিসাব ধরেছে চার-পাঁচদিন আগে পাওয়া চিঠির ! মুখে সে কিছু বলে না। প্ৰাণের মায়া প্রমথর কম নয়, বিপদের পরিমাণটাও তার অজানা নেই। তাকে আরও বেশি ভড়কে দিযে কোনো লাভ হবে না। হ্যা, তার নিজেরই লাভের হিসাব। টাকা পয়সা নাম যশোর লাভ নয়। কালোবাজার লাভালাভের ব্যাকরণগত মানে পর্যন্ত বিকৃত করে দিয়েছে। প্ৰণবের হিসাবে লাভ নেই মানে যে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে সেটা পালন করা, সম্পন্ন করার জন্য প্রমথকে ভড়কে দিয়ে লাভ নেই ! এটা সত্যই আশ্চর্য যে নিজেও সব দেখেশুনে ভালো করে অবস্থা বুঝেও আর না এগোবার কথা প্রমথ একবারও বলেনি। এখানে এসেও ফিরে যাবার কথা সে ভাবছে না, তাহলে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিত না। প্ৰাণের মায়া যত থােক, যতই ভীবু তার প্রকৃতি হােক, ভয়ে বিবৰ্ণ আধমরা হয়েও সে বাকি পথটুকু এগিয়ে যাবে ! হয়তো একেই মনের জোর বলে ! প্ৰণব জানে না। তার এত ভয়ও নেই, এত বেশি মনের জোরের দরকারও তার হয় না। সবটাই তার কাছে অভিনব । গলির ভেতরে একটু এগোলেই মণিমালাদের বাড়ি, বেশি দূর নয়। হয়তো কোনো বিপদ ঘটবে না। কারফিউ ভাঙার জন্য তো নয়ই। দাঁড়িয়ে লাভ নেই, যেতে যদি হয় চলুন।