পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র সপ্তম খণ্ড.pdf/৩২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

স্বাধীনতার স্বাদ W R6ł মণির দুচোখ জলে ভরে যায়। গাল বেয়ে টপ-টপ করে জল গড়িয়ে পড়ে ! কিন্তু সে হিসাবি মেয়ে, বাপ-দাদার জুটিয়ে দেওয পুরুষটার সঙ্গে বহু বছর তিনটে ছেলেমেযে বিইয়ে খাওয়া পরা রোগ-ব্যারাম সামলে, নিজে খেয়ে-পরে আর সবাইকে খাইয়ে-পরিয়ে জীবন কাটিয়েছে, সে জানে এখন কঁদিলেই সর্বনাশ হবে। চোখ দিয়ে জল পড়ে। তবু সে তাই কঁদে না। ন্যাত দিয়ে কড়াই মুছে নতুন ব্যঞ্জন রান্না শুরু করার মতো আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নতুন সুরে বলে, দুবার তুমি আমায় দিশেহারা করেছি। ঠাকুরপো, আর পারবে না। দুবার তোমায় দিশেহারা করেছি ? আমি ? ভীরু নতুন বউ পেয়ে একবার মাথা বিগড়ে দিয়েছিলে। সবাই নিয়মে চালাত, ওঠাত বসােত, তুমি তোমার কলেজি চ্যাংড়ামি আব্ব গোয়ার তুমি দিয়ে নিয়ম ভাঙতে, আমার রাইট নিয়ে ফাইট করতে, বিদ্রোহ করতে শেখাতে। মনে আছে সে সব কথা ? তোমার পাল্লায় পড়ে সংসারের দশজনের সঙ্গে মানিয়ে চলার বদলে স্বাধীন হতে শিখলাম-আহা, কী স্বাধীনতাই শেখালে ! বড়ো ছেলের বউ, বাড়ির হালচাল বুঝে আস্তে-আস্তে দশটা দায়িত্ব নিয়ে বাড়ির একজন হয়ে উঠব সবাই এটা চেয়েছিল-কাজেই ঠিক তার উলটােটা কব, সকলকে পর করে দাও ! উঠতে বসতে ঠোকাঠুকি লাগাও ! একটু যে স্নেহ চায় গালে তার চড় মারো। নইলে নিজেকে বাঁচাতে পারবে না, সবাই তোমায গিলে ফেলবে। কেন ঠাকুরপো ? আমায় কি খেতে পরতে দিত না, গাল দিত, মারত কেউ ? আমায় একটু খুশি করার জন্যেই বরং কে কী করবে ভেবে পেত না। তুমি মাথা বিগড়ে না দিলে আজ কি আমার এ দশা হয় ? এ বাড়িতে ফিরে এসে মনে হয। শত্রপুরীতে এসেছি ? মা বেঁচে থাকলে এ সংসাবে যে ঠাই পেতেন, আমি আজ সেখানে থাকতাম। প্রণব খানিক চুপ করে থেকে বলে, তোমায একটা খবর জানাই। শুনে খুব কষ্ট পাবে। কিন্তু না বলেও লাভ নেই। পবে ভুল ধারণা ভেঙে কষ্ট বরং আরও বেশিই হবে। মণি নীরবে চেয়ে থাকে। শেষের দিকে মা-র মাথাটা একটু খাবাপ হয়ে গিয়েছিল মণিবউদি। তীর্থে যাবার নাম করে পালাতেন, রাস্তা থেকে কুড়িযে আনতে হত। মা-র চিকিৎসায দুবছরে বাবার সমস্ত জমা টাকা শেষ হয়ে গিযেছিল। মা একদিন ছাদ থেকে ঝাপ দিয়ে পড়েছিলেন। বেশি জুরে মা হার্টফেল করেছিলেন। মণির মুখ ছাইবৰ্ণ হয়ে গেছে। তাব নিশ্বাস আটকে আটকে যাচ্ছে। তাই আমরা সবাইকে বলেছিলাম। বাড়ির সকলেও জানত না। গুরুদেব এসেছিলেন। মা-র কথা সব শূনে বাবাকে বললেন, ছাদে একটা সর্বতীর্থ সৃষ্টি করতে হবে, তিন দিন হােমপূজা চলবে। মা যেন হঠাৎ সুস্থ হয়ে গেলেন, সারাদিন ছাদে সব আয়োজন করতে মেতে গেলেন। আমি বাড়ি ছিলাম না, অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরতেই মা আমায় ছাদে ডেকে নিয়ে গেলেন। বোধ হয় আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, খোকা, আমায় সব তীর্থ দেখাবি বলেছিলি, এই দাখ, সব তীর্থ তৈরি হচ্ছে। তোরা বাপ-বাটায় আমায় ঠিকাচ্ছিস কেন রে ? ঠাকুরপো । মা-র প্রত্যেকটি কথা মনে গাঁথা হয়ে আছে, একটি শব্দও এ জীবনে ভুলব না। মা বলেছিলেন, বুড়ো বয়সে তীৰ্থও করতে দিবি না তোরা ? গোরু-ছাগলের মতো ঘরের গোয়ালে মরতে পারব না। খোকা। তীর্থে আমি যাবই। বলেই সোজা গিয়ে রেলিং ডিঙিয়ে বঁাপিয়ে পড়লেন। কড়াইয়ে তরকারি পুড়ে যেতে শুরু করে। মণির হাত থেকে খুস্তি খসে পড়েছে। কথা বলতে বলতে ধ্রুব এমনভাবে হাতে হাত কচলিয়ে চলেছিল যেন তার মায়ের হত্যকারীদের টুটি দুহাতে চেপে মারছে।