পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র সপ্তম খণ্ড.pdf/৩৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

স্বাধীনতার স্বাদ (Dዒ¢ মালতীন্দি ? ভূপেনবাবুর স্ত্রী ? দ্যাখেননি ? উনি সামনে ছিলেন। ওঁর তিনটি ছেলে, চারটি মেয়ে। স্বামী আর বড়ো ছেলে চাকরি করে। উনি মজুর-চাষির সঙ্গে ভিড়বেন এটা তাদের পছন্দ নয়। মাঝে মাঝে ঝগড়া হয়, উনি কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিতে যান। মালতীন্দি পরিষ্কার বলেন, বেশ, তোমরা আমায় না চাও, আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। দুজন নরম হয়ে যায়। মণি চুপ করে থাকে। গোকুল বুঝে বলে, কেন নরম হয় জানেন ? সবাই ভালো করেই জানে যে, মালতীন্দির কথা আর কাজে তফাত নেই, নিজের মতে চলতে না দিলে তিনি সত্যিই বেরিয়ে যাবেন। তাছাড়া, পছন্দ না করুক, ওরা জানে মালতীন্দির আদৰ্শই খাঁটি ! মা-র জন্য চাকরি যাবার ভয়ে ছেলেই আগে রাগারগি করত বেশি, এমনিতেই এখন ছাঁটাই তার মাথায় ঝুলছে। আজকাল সে চুপ করে থাকে। মণি চুপ করে থাকে। গোকুল একটা বিড়ি ধরায়। খানিকক্ষণ চেয়ে থাকে। মণির মুখের দিকে। বুঝতে পারে, উদ্ধত অভিমানের সঙ্গে কোনো ইচ্ছার জোর চেতন মনের সঙ্গে লড়াই করছে। তার কথাটা এখনও স্পষ্ট হয়নি। সুশীলদা কিন্তু নরম হবেন না। ওঁর মতিগতি অন্য রকম। সংসারের চেয়ে ওঁর কাছে সংসারের দখলিস্বত্ব বড়ো, তার চেয়ে বড়ো টাকার সুখ, আরাম-বিলাস। মনে-প্ৰাণে টাকার কাছে দাসখত লিখে দিয়েছেন, বড়ো বড়ো ডাকাতরা যে লুট চালাচ্ছে উনি তার ছিটেফোটা ভাগ চান, অন্তত যাতে একখানা বাড়ি একখানা গাড়ির মতো আরাম-বিলাস মান-সম্মান হয়। মণি চুপ করেই থাকে। বউ ছেলেমেয়ে এই আদর্শ জীবনের বিরোধী হলে, বাধা দিলে, সুশীলদা সইবেন না। দরকার হলে সবাইকে তাড়িয়ে দেবেন, আবার বিয়ে করে সংসার পাতবেন। মণি এবার হেসে ফেলে। গোকুলের কথাটা হাস্যকর বা অসম্ভব বলে নয়, সুশীল আবার বিয়ে করবে। ভাবলেই তার হাসি পায়। বলে, দেখাই যাক। আমার কর্তব্য আমি করব, তাতে না পোষায়, তাড়িয়ে দেবে। কিন্তু তুমি কী করে জানলে আমায় চরম নোটিশ দিয়েছে ? আমি তো কাউকে কিছু दक्लेिनि ! নোটিশ ? কীসের নোটিশ ? এমনিই আন্দাজ করছ তোমার সুশীলদা দরকার হলে আমায় ত্যাগও করতে পারে ? মানুষ দেখে বোঝা যায় না তার পক্ষে কী সম্ভব ? কেবল আশা ও সুধীন নয়, তাদের সঙ্গে মণিও গেল বিক্ষোভ প্রদর্শনে। বোধ হয় গোকুলের সঙ্গে আলোচনার ফলে । গোকুল বলে, আপনি কিন্তু সুশীলদার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাতে যাচ্ছেন মণিবউদি। মণি মাথা নাড়ে। শুধুই সে জন্য নয়। তোমাদের মতো অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতেও যাচ্ছি। এমনি হয়তো যেতাম না, তা ঠিক। কিন্তু কারণ ছাড়া মানুষ কীভাবে এ সব কাজে নামে আমি বুঝি না ভাই। মানুষের মতো জীবন হলে এ সব নিয়ে মাথা ঘামাতে যাব। কীসের গরজে ? আমার বেলা কারণটা খাপছাড়া হতেও পারে, কিন্তু কারণ তো একটা থাকবেই। তুমিও কি অকারণে যােচ্ছ, ছাঁকা আদর্শের খাতিরে ? জীবনের কার্যকারণের সঙ্গে যোগ নেই, সে কী রকম আদর্শ বুঝি না ভাই। • গোকুল লজ্জিত হয়ে বলে, আমিই ভুল বলেছি।