পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
লুৎফ উন্নেসা
১২১

বিরুদ্ধে একটি ভীষণ ষড়যন্ত্রের অভিনয় হইতেছিল। আমরা পূর্বে বলিয়াছি যে, সিরাজের বুদ্ধির তাদৃশ স্থিরতা ছিল না এবং যদিও তিনি মাতামহের অনুরোধে মদ্যপান পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, তথাপি পূর্বের অভ্যাস-দোষ তাহার চঞ্চল চিত্তকে অধিকতর চঞ্চল করিতেছিল। তিনি সিংহাসনে আরোহণ করিয়া, চারিদিকে হিংসা, বিদ্বেষ ও ষড়যন্ত্রের বিভীষিকাময় চিত্র দেখিতে লাগিলেন। কাহারও উপর তিনি সহজে বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারিতেন না, যাহাকে তিনি বিশ্বাস করিতেন, সে-ই তাহার সর্বনাশ-সাধনে প্রবৃত্ত হইত। দুই-একজন ব্যতীত তাহার প্রধান প্রধান সেনাপতি ও কর্মচারী সকলেই তাহার সর্বনাশসাধনে উদ্যত। এইরূপ অবস্থায় তাহার হৃদয় কিরুপ অশান্তিকর হইয়া উঠিয়াছিল, তাহা সহজে অনুমান করা যাইতে পারে। কিন্তু একজন মাত্র তাহার সেই দগ্ধহৃদয়ে শান্তিবারি প্রদান করিয়া তাহার চঞ্চল চিত্তকে কিয়ৎ পরিমাণে স্থিরতর করিতে চেষ্টা পাইতেন, তিনিই লুৎফ উন্নেসা। লুৎফ উন্নেসা তাহার প্রত্যেক কার্যে সমবেদনা প্রকাশ করিয়া, তাহার দুশ্চিন্তা-দাবদগ্ধহৃদয়ে শান্তির স্নিগ্ধবারি সেচন করিতেন।

 বিশ্বাসঘাতক ষড়যন্ত্রকারিগণের কৌশলে, যখন পলাশীর রণক্ষেত্রে পরাজিত হইয়া, যুদ্ধস্থল হইতে পলায়নপর সিরাজ মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হইলেন, তখন তাহার সে চিত্র মনে হইলে, করুণরসে হৃদয় অভিষিক্ত হইয়া উঠে। তিনি যাহার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন, সেই তাহার প্রতি বিমুখ হয়। গভীর রাত্রি, চারিদিকে কেমন একটা বিষাদের ছবি সিরাজের চক্ষের সমক্ষে নাচিয়া বেড়াইতেছে! মুর্শিদাবাদে মীরজাফরের ও পলাশীর পথে ইংরেজ-সৈন্যের সানন্দ-কোলাহল ও বিজয়বাদ্য চতুর্দিক প্রতিধ্বনিত করিতেছে; তাহাদের প্রত্যেক আঘাতে সিরাজের মর্মস্থল ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। সিরাজ ছিন্নকণ্ঠ কপোতের ন্যায় অত্যন্ত অস্থির হইয়া উঠিলেন; তাঁহার মস্তিষ্ক হইতে বিবেচনাশক্তি যেন চিরবিদায় লইয়াছে বলিয়া বোধ হইতে লাগিল; কি করিবেন কিছুই স্থির করিতে পারলেন না। কোনও কোনও বিশ্বাসী বন্ধুর কথায় সিরাজ একবার নগররক্ষা করিতে ইচ্ছা করিলেন, আবার বিশ্বাসঘাতকের পরামর্শ দিল, পলায়ন কর; নতুবা তোমার নিস্তার নাই। সিরাজ অনন্যোপায় হইয়া তাহার অনুগমন করিবার জন্য সকলের পদতলে বিলুষ্ঠিত হইতে লাগিলেন। যাঁহারা তাহার চরণ স্পর্শ করিবারও উপযোগী নহে, আজ সিরাজ তাহাদেরও কৃপার ভিখারী। কিন্তু কেহই তাহার সেই কাতরোক্তিতে কৰ্ণপাত করিল না। এমন কি, তাঁহার শ্বশুর পর্যন্ত তাঁহার সহিত একপদ গমন করিতে স্বীকৃত হইলেন না। যতই বিপক্ষগণের বিজয়ধ্বনি শুনিতে পান, ততই সিরাজের প্রাণ কম্পিত হইতে থাকে। তখন তিনি স্বীয় প্রিয়তমা লুৎফ উন্নেসার নিকট ভগ্নহৃদয়ে উপস্থিত হইলেন এবং তাহাকে সঙ্গে লইতে ইচ্ছা করিলেন। লুৎফ উন্নেসা বাক্যব্যয় না করিয়া দুই-একজন দাসীর সহিত স্বামীর পশ্চাঁদবর্তিনী হইলেন।

 ভীষণ দ্বিপ্রহর রজনীতে বাঙ্গলা বিহার উড়িষ্যার অধিপতি ও অধীশ্বরী সামান্য