পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
১২২
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

যানে আরোহণ করিয়া, রাজধানী পরিত্যাগ করিলেন। নৈশান্ধকার তাঁহাদের মুখে আবরণ প্রদান করিল, মধ্যে মধ্যে শৃগাল ও পেচকের ভীষণ শব্দ তাঁহাদের মনে ভীতির উৎপাদন করিতেছে,—নিকটে কোনও শব্দ শুনিলে মীরজাফরের চর বলিয়া তাঁহারা চমকিত হইয়া উঠিতেছেন,—এইরূপ অবস্থায় ক্রমশঃ তাঁহারা ভগবান্গোলার দিকে অগ্রসর হইলেন। সিরাজ যতই গমন করেন, ততই চঞ্চল হইয়া উঠেন; বিশেষতঃ লুৎফ উন্নেসার জন্য তিনি নিরতিশয় ব্যাকুল হইতে লাগিলেন। কিন্তু সেই দেবহৃদয়া নিজে কিছুমাত্র ক্লান্তি অনুভব না করিয়া, প্রাণপণে স্বামীর কষ্ট নিবারণে যত্নবতী হইলেন। রাত্রি প্রভাত হইল; নিদাঘতপন স্বীয় প্রচণ্ড কিরণ ছড়াইতে ছড়াইতে দেখা দিলেন; ক্ৰমে রৌদ্রে ও রৌদ্রতপ্ত ধূলিতে সিরাজের কমনীয় মুখমণ্ডল আরক্ত হইয়া উঠিল; স্বেদজলে ললাট ও গণ্ডস্থল অবিরত সিক্ত হইতে লাগিল। লুৎফ উন্নেসা স্বামীর সেই ক্লেশ নিবারণার্থ অবিরত চেষ্টা করিতে লাগিলেন। নিজের শরীর সূর্যোত্তাপে দগ্ধ হইয়া যাইতেছে—ভ্রূক্ষেপ নাই! কিসে স্বামীর ক্লান্তি দূর করিবেন, তজ্জন্য অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিলেন।

 এইরূপে র্তাঁহারা ভগবান্‌গোলায় উপস্থিত হইয়া তথা হইতে নৌকারোহণে রাজমহাল অভিমুখে যাত্রা করিলেন। পদ্মার উত্তাল তরঙ্গমালা দেখিয়া চিরসুখাভ্যন্ত সিরাজের প্রাণ কাঁপিতে লাগিল; কিন্তু সেই দেবহৃদয়া তাহাতে বিচলিত হইলেন না। তিনি নিজে স্বামীকে সঙ্গে লইয়৷ সেই ক্ষুদ্রতরণীতে আরোহণপূর্বক গমন করিতে লাগিলেন। মধ্যে মধ্যে তরঙ্গের পশ্চাৎ তরঙ্গ আসিয়া সেই ক্ষীণকলেবর তরণীকে রসাতলে প্রেরণের উপক্ৰম করিতে লাগিল। সিরাজ জীবনের আশা বিসর্জন দিয়া ভীত ও চমকিত হইতে লাগিলেন, কিন্তু লুৎফ উন্নেসা তাহাকে শান্ত করিয়া সলিলসিক্ত স্বামীর অঙ্গপ্রতঙ্গ মুছাইতে আরম্ভ করিলেন। মধ্যে মধ্যে নিদাঘের বৃষ্টি তাহাদিগকে অস্থির করিয়া তুলিতে লাগিল। লুৎফ উন্নেসা সিরাজকে আচ্ছাদন করিয়া, তাহা হইতে তাঁহাকে রক্ষা করিতে যত্নবতী হইলেন। সঙ্গে চারি বৎসরের একমাত্র বালিকা কন্যা উম্মৎ জহুরা। সিরাজ এক-একবার তাহার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া কাঁদিয়া আকুল হন, পাছে তাহার সর্বস্বধন পদ্মার তরঙ্গে ভাসিয়া যায়! কিন্তু লুৎফ উন্নেসা তাহার প্রতিও দৃকপাত না করিয়া, স্বামীর কষ্ট নিবারণার্থ অত্যন্ত ব্যাকুলা হইয়া উঠিলেন। এইরূপে তিন দিন তিন রাত্রি অনাহারে কাটাইয়া তাহার রাজমহালের নিকট উপস্থিত হন। এই সময়ে সিরাজ আপনাদিগের জন্য কিছু খিচুড়ী প্রস্তুতের ইচ্ছা করেন। দানাশাহ নামে এক ফকীর।[১] তাঁহাদের

  1. দানশাহ প্রথমে সিরাজকে চিনিতে পারে নাই, কিন্তু তাহার বহুমূল্য পাদুকা দেখিয়া তাহার সন্দেহ হয়; পরে নৌকার মাঝিদিগকে জিজ্ঞাসা করায়, তাঁহারা সমস্ত বলিয়া দেয়। অদ্ভুতপ্রকৃতি ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ লিখিয়া থাকেন যে, সিরাজ নাকি স্বীয় সৌভাগ্যসময়ে দানাশাহের কান কাটিয়া দিয়াছিলেন! (Ives's Voyage, p. 151. Also Orme's Indostan, Vol. Il, p. 183.)। কিন্তু মুত্যক্ষরীনে যাহা লেখা আছে, তাহার ইংরেজী অনুবাদ