পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
১২৮
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

 কিন্তু পলাশী হইতে যে আমাদের সম্পূর্ণ লাভ ঘটিয়াছে, এ কথা বলিতে পারা যায় না। পলাশী এক দিকে যেমন ব্রিটিশ-শিল্পের উন্নতি করিয়াছে, অন্য দিকে তেমনি ভারতীয় শিল্পের মস্তকে পদাঘাত ঘটাইয়াছে। এক দিকে যেমন ইউরোপের মধ্যবিত্তগণ ধনকুবের হইতেছেন, অন্য দিকে ভারতের মধ্যবিত্তগণ তেমনি অন্নাভাবে শ্মশানকঙ্কালের ন্যায় হইয়া উঠিতেছে। এক দিকে যেমন পাশ্চাত্ত্যজ্ঞানবিজ্ঞান আমাদিগকে আলোকিত করিয়াছে, আর এক দিকে তেমনি আমাদিগের জাতীয় ভাবের অস্তিত্ব লোপ করিতে বসিয়াছে। এক দিকে যেমন আমাদিগের অলস হৃদয় উৎসাহের প্রতপ্ত মদিনাপানে কার্যক্ষম হইতেছে, অন্য দিকে তেমনি হৃদয় হইতে সরল বিশ্বাস অন্তর্হিত হইয়া সন্দেহের বিষময় বীজ দিন দিন অঙ্কুরিত হইয়া উঠিতেছে। ভারতে এক্ষণে জাতিও নাই, জাতীয় ভাবও নাই। সে রাজপুত নাই, সে মহারাষ্ট্রীয় নাই, সে শিখও নাই—সে ধর্মপিপাসা নাই, সে স্বদেশভক্তি ও স্বজাতিপ্রীতিও নাই। পুরাকালের কথা বলিতেছি না, মুসলমানরাজত্বে যাহা ছিল, এখন তাহারও ছায়ামাত্র দেখিতে পাওয়া যায় না। পলাশী যেমন সমস্ত ভারতবাসীকে শান্তিময় ন্যায়ানুমোদিত শাসনের স্নিগ্ধ সুখ অনুভব করাইয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে তাহাদিগকে দরিদ্র ও অবিশ্বাসী করিয়া হৃদয়ের শান্তিঘট অশান্তির বগুড়াঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া দিয়াছে। বাহ্য শান্তির চরমোৎকর্য ঘটিয়াছে বটে, কিন্তু আভ্যন্তরিক শান্তি ধীরে ধীরে যেন কোন অনিশ্চিত রাজ্যে পলায়ন করিতেছে। ইংরেজশাসনে যে এই দোষ ঘটিয়াছে, আমরা সে কথা বলিতেছি না। জাতীয় শিক্ষার অভাবেই পাশ্চাত্ত্য জ্ঞানের সংঘর্ষ সহ্য করিতে না পারিয়া আমরা জাতীয়তা হারাইতে বসিয়াছি। এ বিষয়ে অধিক আলোচনার প্রয়োজন নাই, আপাততঃ বর্তমান প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয়ই বণিত হইতেছে।

 বর্তমান প্রবন্ধে পলাশী যুদ্ধের একটি সংক্ষিপ্ত মর্ম প্রদান করিয়া, পূর্বতন ও আধুনিক পলাশীপান্তরের একটি বিবরণ বর্ণন করাই আমাদের উদ্দেশ্য। পলাশীপ্রান্তর মুর্শিদাবাদ হইতে প্রায় পঞ্চদশ ক্রোশ দক্ষিণে অবস্থিত। ইহার পশ্চিম পার্শ্ব দিয়া প্রসন্নসলিলা ভাগীরথী কুল কুল রবে প্রবাহিত হইতেছেন; দক্ষিণে পলাশী গ্রাম। সেইজন্য এই ইতিহাস বিখ্যাত প্রান্তরের নাম পলাশীপ্রান্তর। পলাশী নামে একটি বিশাল পরগণা মুর্শিদাবাদ ও নদীয়ার মধ্যে বিরাজ করিতেছে। পলাশী গ্রাম ও পলাশীপ্রান্তর প্রভৃতি সমুদায়ই উক্ত পরগনার অন্তর্ভূত। মুর্শিদাবাদ হইতে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত যে প্রসিদ্ধ বাদশাহী সড়ক ভাগীরথীর পূর্বতীর দিয়া গমন করিয়াছে, সেই বিস্তৃত সড়ক পলাশীপ্রান্তর ভেদ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। ভাগীরথীর গতি-প্রভাবে পূর্বতন সড়ক হইতে বর্তমান সড়কের কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঘটিয়াছে। এইরূপ শুনা যায়, পূর্বে এই সকল স্থানে অনেক পলাশ বৃক্ষের শ্রেণী থাকায় ইহাকে পলাশী বলিত; কিন্তু এক্ষণে তাহাদের কোন চিহ্ন দেখিতে পাওয়া যায় না। খ্রীস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দী হইতে পলাশীর আম্রকুঞ্জের নামই কীর্তিত হইয়া আসিতেছে; পলাশীতে লক্ষ বৃক্ষের