পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
১৩২
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

প্রায় পলাশীগ্রাম পর্যন্ত নবাব-সৈন্য দুর্লভরাম, ইয়ার লতিফ ও মীরজাফরের অধীন সুসজ্জিত অবস্থায় দণ্ডায়মান হইল। দুর্লভরাম উত্তর-পশ্চিম দিকে পাহাড়ীর নিকটে, ইয়ার লতিফ মধ্যভাগে এবং মীরজাফর দক্ষিণ-পশ্চিমে আম্রকুঞ্জের দক্ষিণ-পূর্ব ও পলাশী গ্রাম হইতে অল্প ব্যবধানে মহাসমরের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।[১] বলা বাহুল্য, দুর্লভরাম, ইয়ার লতিফ ও মীরজাফর তিনজনই বিশ্বাসঘাতক ও ষড়যন্ত্রকারিগণের নেতা; এবং ইহাদের নেতৃত্বে নবাবের সর্বাপেক্ষা অধিক সৈন্য ছিল। যুদ্ধকালে ইহারা সামান্যমাত্র পদবিক্ষেপও করেন নাই। ক্লাইব আম্রকুঞ্জের নিকটস্থ শিকারমঞ্চ হইতে শরুপক্ষের সৈন্যসাগর নিরীক্ষণপূর্বক ভীত হইয়া পড়িলেন। তাহাদিগকে অগ্রসর হইতে দেখিয়া, তিনি স্বীয় সৈন্যদিগকে কুঞ্জ হইতে বহির্গত হইতে আদেশ দিয়া, মঞ্চের পূর্ব হইতে তাহার সহিত সমরেখ করিয়া সৈন্যদিগকে শ্রেণীবদ্ধ করিলেন। সম্মুখে একটি যৎসামান্য বুরুজ নির্মাণ করিয়া, তাহাতে কামানসকল রক্ষা করা হইল। ক্লাইব বামভাগের সৈন্যদিগের কতক অংশকে অগ্রসর হইয়া ৪ শত হস্ত দূরে দুইটি ইষ্টকের পাঁজার পশ্চাঁদ্ভাগে অবস্থিতি করিতে আদেশ দিলেন।

 বেলা আট ঘটিকার সময় প্রথমে সিনফ্রের অধীন সৈন্যগণ গোলাবৃষ্টি আরম্ভ করিল। ইংরেজেরাও তাহার প্রতিবর্ষণ করিলেন। তিন ঘণ্টা কাল গোলায় গোলায় যুদ্ধ চলিল। ক্লাইব কোনরূপ সুবিধা বুঝিতে না পারিয়া, সৈন্যদিগকে পশ্চাৎ হটিয়া আম্রকুঞ্জমধ্যে প্রবেশ করিতে আদেশ দিলেন এবং অন্যান্য সামরিক কর্মচারীর সহিত পরামর্শ করিয়া রাত্রিযোগে নবাবকে আক্রমণ করিবার ইচ্ছা করিলেন। এই সময়ে এক পশলা বৃষ্টি হওয়ায়, নবাবের সমস্ত বারুদ ভিজিয়া যায়। ইংরেজের আপনাদিগের বারুদ আবরণ দ্বারা রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। বারুদ ভিজিয়া যাওয়ায়, নবাবকে বিলক্ষণ ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হয়। ইংরেজ-সৈন্য আম্রকাননে প্রবিষ্ট হইতেছে দেখিয়া, নবাবের প্রধান সেনাপতি মীরমদন একদল অশ্বারোহী সৈন্যসহ কুঞ্জাভিমুখে অগ্রসর হইলেন; কিন্তু অধিক দূর যাইতে না যাইতেই ইংরেজদিগের একটি গোলা আসিয়া তাহাকে সাংঘাতিকরূপে আহত করিল; ইহাতে নববসৈন্য অত্যন্ত সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িল। মীরমদনের পশ্চাদ্ভাগে হিন্দুবীর মোহনলাল অবস্থিতি করিতেছিলেন। তিনি তাহাদিগকে উৎসাহিত করিয়া, ইংরেজদিগকে মথিত করিবার জন্য মহাবেগে ধাবিত হইলেন। তাহার আক্রমণে ইংরেজসৈন্যগণ অস্থির হইয়া ক্রমশঃ কুঞ্জমধ্যে প্রবিষ্ট হইতে লাগিল। <re>মীরমদনের মৃত্যুর পর মোহনলালের অগ্রসর হওয়ার কথা Orme, Broome, Malleson প্রভৃতি প্রধান প্রধান ইংরেজ ঐতিহাসিকগণের গ্রন্থে উল্লিখিত হয় নাই। একমাত্র Stewart-এ উল্লিখিত হইয়াছে। সায়র উল মুতাক্ষরীনে প্রথমে এই ঘটনা উল্লিখিত হয়, (Mutaqherin, Trans. Vol. I, p. 768); স্টুয়ার্ট তাহা হইতেই গ্রহণ করিয়াছেন। মোহনলালের এই অদ্ভুত বীরত্বকাহিনীর উল্লেখ করিতে ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ কি জন্য বিস্মৃত হইলেন, বলিতে পারি না। যদি সিরাজউদ্দৌলা তাহাকে প্রতিনিবৃত্ত হইতে আদেশ না। দিতেন, তাহা হইলে ইংরেজদিগের যে সর্বনাশ সংসাধিত হইত, এই কথা গোপন কবিার জন্যই বোধ হয় কোন কোন ঐতিহাসিক ইচ্ছাপূর্বক নীরব হইয়াছেন। কিন্তু ম্যালীসনের ন্যায় নিরপেক্ষ ঐতিহাসিককে নীরব থাকিতে দেখিয়া আমরা যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইয়াছি।</ref> ইতিমধ্যে এক মহা ব্যাপার উপস্থিত হইল।

  1. মেজর রেনেল, এই সৈন্যাবস্থানের একটি চিত্র অকিত করিয়াছিলেন। লর্ড কর্জনের উপদেশে সেই চিত্র অবলম্বনে পলাশী প্রান্তরে স্তম্ভ সকল স্থাপিত হইয়াছে।