পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
খোশ্‌বাগ
১৪৩

চক্রে রাজ্যচ্যুত হইয়া খণ্ড-বিখণ্ডিত দেহে জীবন বিসর্জন দিয়াছিলেন, আলিবর্দীর প্রিয়তম ও ইংরেজের মহাকষ্টক সেই সিরাজও মাতামহের পার্শ্বে নিদ্রিত। তাহারও পদতলে তাহার সেই সুখ-দুঃখের একমাত্র সঙ্গিনী লুৎফ উন্নেসাও মহাশান্তিতে নিমগা। এই মিচ্ছায়াসমন্বিত শান্তিনিকেতন খোশ্‌বাগ মুর্শিদাবাদের মধ্যে একটি প্রধান বৈরাগ্যোদ্দীপক স্থান। এখানে আসিলে, স্মৃতি আলিবর্দী ও সিরাজের অনেক কথা মনে উদয় করিয়া দেয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর সমস্ত চিত্র ধীরে ধীরে মানসপটে বিকাশ পাইতে থাকে। সেই মহারাষ্ট্রীয়যুদ্ধ, সেই আফগানিসমর, পলাশী রণক্ষেত্রে মুসলমান। রাজলক্ষীর সেই মর্মভেদী দৃশ্য-সমস্তই মনে হয়, এবং সেই বঙ্গাধীশ্বরগণের বর্তমান ধূলিপরিণতি দেখিয়া কালরহস্যেও চমৎকৃত হইতে হয়। |

 খোশ্‌বাগের কিছু দূরে ভাগীরথী সিকতাস্তূপে আত্মবিলয় করিয়া চলিয়া যাইতেছেন; বর্ষাকালে না জানি কি উচ্ছাসে উচ্ছ্বসিত হইয়া, খোশ্‌বাগের প্রাচীরপ্রান্ত স্পর্শ করিয়া থাকেন। চারিদিকে আমি, বাদাম প্রভৃতি বৃহৎ বৃহৎ বৃক্ষ আপনাদিগের দূরব্যাপী শাখা বিস্তার করিয়া ছায়ায় ছায়ায় সমাধি-ভবনটি ছাইয়া ফেলিয়াছে। প্রভাতে, মধ্যাহে ও সায়াহে ঘুঘুর দল সেই সমস্ত বৃক্ষশাখার পত্রান্তরালে বসিয়া, গম্ভীর। বিষাদসঙ্গীতে সমাধিভবনটিকে আরও বিষাদময় করিয়া উপস্থিত জনগণের চিত্তপটে কেমন এক উদাসভাবোদ্দীপক চিত্র অঙ্কিত করিয়া তুলে। কুন্দ, কামিনী প্রভৃতি কুসুমরাজি প্রস্ফুটিত হইয়৷ নীরবে সেই সমাধিভবনতলে ঝরিয়া পড়িতেছে; কচিৎ তাঁহারা সমাধিগুলির উপর স্থান পাইয়া থাকে। খোশ্‌বাগের সহিত বৈরাগ্যের যেরূপ সংমিশ্রণ, অনেক স্থলে সেরূপ দেখিতে পাওয়া যায় না। যে-সিরাজের নাম বাঙ্গলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মুখে প্রবাদবাক্য রূপে প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হইয়া থাকে, তাহার সমাধিদর্শনে তাহার ভীষণ শোচনীয় পরিণামচিন্তা স্বতঃই হৃদয়ক্ষেত্রে আবির্ভূত হইয়া নিতান্ত বিষয়ী ললাকেরও বৈরাগ্য উৎপাদন করিয়া থাকে। যিনি একসময়ে বঙ্গরাজ্যের অধীশ্বর হইয়া ক্ষমতাশালী ইংরেজ জাতিকে উন্মলিত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাহার শেষ দুর্গতি ও বর্তমান ধূলিশয়ন মনে পড়িলে, কাহার না সংসারবৈরাগ্য উপস্থিত হয়? প্রাকৃতিক অবস্থান ও ভাবোদ্বোধনহেতু খোশ্‌বাগ একটি শ্রেষ্ঠ বৈরাগ্যভূমি বলিয়া অনুমিত হয়। এই নির্জন স্থানে লোকজনের প্রায়ই গতায়াত নাই। সমাধিরক্ষকের সময়ে সময়ে উপস্থিত হইয়া থাকে। এখানে কেবল দলবদ্ধ শাখামৃগগণ ব্যতীত আর কাহারও সহিত সাক্ষাৎ হইবার সম্ভাবনা নাই।

 খোশ্‌বাগের সমাধিভবন প্রধানতঃ দুইটি চত্বরে বিভক্ত। প্রথমটি প্রবেশদ্বার হইতে আরম্ভ হইয়াছে। দ্বিতীয় চত্বরটি প্রথমটির পশ্চিম দিকে। এই দ্বিতীয় চত্বরে প্রবেশ করিবার জন্যও আর একটি প্রবেশদ্বার আছে। ভাগীরথীতীর হইতে অতি অল্প দূরেই খোশ্‌বাগের সমাধিভবন অবস্থিত; ইহার চতুদিক প্রাচীরবেষ্টিত। প্রবেশদ্বারটি পূর্বমুখ; প্রবেশদ্বারের দুই পার্শ্বে দুইটি প্রকোষ্ঠ আছে। প্রবেশদ্বারটি এত বৃহৎ যে, তাহার মধ্য দিয়া অনায়াসে হস্তী গমনাগমন করিতে পারে। প্রাচীরের