পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
খোশ্‌বাগ
১৪৫

তিনি পানাহারের প্রতি তাদৃশ মনোযোগ প্রদান করিতেন না। ক্রমে ক্রমে রোগের আক্রমণ বৃদ্ধি পাইলে, দেশের যাবতীয় লোক তাহার নিকটে সমাগত হইতে লাগিল। তাহার পরিবারবর্গের মুখশ্রী ম্লান হইয়া গেল। এই সময়ে সিরাজউদ্দৌলার সহিত ঘসেটী বেগমের বিবাদ গুরুতর ভাবেই চলিতেছিল। ঘসেটী যে ইংরেজদিগের সহিত সিরাজের বিরুদ্ধে পরামর্শ করিতেছিলেন, আলিবর্দী সে কথা জানিতে পারিলেন। তিনি ইংরেজদিগের রাজ্যলালসার কথা বুঝিতে পারিয়া, সিরাজকে উপদেশ দিয়া যান যে, ইংরেজদিগকে যেরূপে পার দাসানুদাসের ন্যায় দমন করিয়া রাখিবে; ইংরেজদিগকে দমন করিতে না পারিলে, তাঁহারা নিশ্চয়ই তোমার রাজ্য অধিকার করিয়া বসিবে।

 মুতাক্ষরীনকার লিখিয়াছেন যে, নবাবের মৃত্যুর পূর্বে নগরের প্রধান প্রধান ব্যক্তি সমবেত হইয়া, সিরাজউদ্দৌলার হস্তে তাহাদিগের হস্ত বিন্যাস করিয়া, তাহাদিগকে প্রীতির চক্ষে দেখিবার জন্য সিরাজকে অনুরোধ করিতে নবাবের নিকট প্রার্থনা করেন। নবাব তাহাতে এইরূপ উত্তর প্রদান করিয়াছিলেন যে, যদি তোমরা আমার মৃত্যুর পর তিন দিবস পর্যন্ত সিরাজের মাতামহীর সহিত তাহার সদ্ভাব দেখিতে পাও, তাহা হইলে তোমাদের কতকটা আশা থাকিতে পারে।[১] মুতাক্ষরীনকারের এই কথায় শ্রদ্ধাস্থাপন করিতে আমাদের প্রবৃত্তি হয় না। যে আলিবর্দী কূটনীতিবিশারদ ইংরেজদিগকে দমন করিবার জন্য সিরাজকে পুনঃ পুনঃ উপদেশ দিয়াছিলেন, তাহার যে সিরাজের প্রতি ঐরূপ ঘূণাব্যঞ্জক ভাব ছিল তাহা আমরা বিশ্বাস করিতে পারি না। বরং সিরাজের প্রতি তাহার ভাব অন্য প্রকারই ছিল, আমরা অনেক স্থলে তাহার প্রমাণ পাইয়াছি। সিরাজ মসনদে বসিয়া যে মাতামহীর আজ্ঞা লঙ্ঘন করেন নাই, তাহারও যথেষ্ট প্রমাণ আছে।

 ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর করাল ছায়া আলিবর্দীকে অভিভূত করিয়া ফেলিল। তিনি ১১৬৯ হিজরীর ৯ই রজব তারিখে (১৭৫৩ খ্রীঃ অব্দের ৯ই এপ্রিল) চিরদিনের জন্য চক্ষু মুদ্রিত করিলেন। বাঙ্গলার আদর্শ নবাব হিন্দুর পরম মিত্র, মহারাষ্ট্রীয় ও আফগানদিগের দর্পচূর্ণকারী, মহামহিমান্বিত আলিবর্দী খাঁ মহবজঙ্গ অনন্তকালের জন্য মধাম পরিত্যাগ করিয়া, কোন অজ্ঞাত প্রদেশে চলিয়া গেলেন। তাহার অবসানে মুসলমান রাজলক্ষীর কিরীট শিথিল হইতে আরম্ভ হইল এবং ইংরেজ রাজলক্ষীর জ্যোতিঃ সহসা ভারতাকাশে বিকীর্ণ হইয়া পড়িল। অনেক দিন হইতে ইংরেজের। স্বর্ণপ্রসবিনী ভারতভূমির প্রতি যে আশায় সতৃষ্ণনয়নে দৃষ্টিপাত করিতেছিলেন, এতদিনে সে আশা ফলবতী হইতে চলিল। হতভাগ্য সিরাজ বুঝিতে পারিলেন না যে, তাহার ভাগ্যাকাশ ঘোর অন্ধকারময় হইয়া উঠিতেছে! আলিবর্দীর মৃত্যুতে সমস্ত বঙ্গরাজ্যের প্রজারা হাহাকার করিতে লাগিল; মহারাষ্ট্রীয় ও আফগান দস্যুভয়ে তাহাদের হৃদয় কম্পিত হইয়া উঠিল; সমস্ত বঙ্গরাজ্যে যেন কেমন একটা বিপদের ১০

  1. Mutaqherin, Trans. Vol. I, p. 682.