পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
১৪৮
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

স্বীয় প্রভুপত্নীর ধর্মনাশ সাধন করিয়া, একটি সংসারকে ঘোরতর পাপপকে নিমগ্ন করিয়াছিল, ভগবানের অপক্ষপাত বিচারে সে যদি সাধুপ্রকৃতি বলিয়া পরিগণিত হয়, আর যে স্বীয় জননীর ধর্মধ্বংসকারীর হত্যার আদেশ প্রদান করিয়াছিল, সে যদি শয়তানতুল্য বলিয়া বিবেচিত হইয়া উঠে, তাহা হইলে, ন্যায়ধর্ম ভগবানের রাজ্যে আছে বলিয়া কে বিশ্বাস করিতে পারে? ভগবানের এরূপ বিসদৃশ নীতি যাহাদের ইচ্ছা হয়, অনুমোদন করিতে পারেন, আমরা কিন্তু যতদিন পর্যন্ত ন্যায়, ধর্ম ও পবিত্রতা জগতে বিদ্যমান থাকিবে, ততদিন তাহা কদাচ অনুমোদন করিতে পারিব না।

 যাহা হউক, সিরাজের ছিন্নভিন্ন দেহ হস্তিপৃষ্ঠে মুর্শিদাবাদের প্রতি রাজপথে ভ্রমণ করাইয়া, অবশেষে তাহার মাতার বাসভবনের দ্বারে আনীত হয়। অন্তঃপুরু মধ্যে আবদ্ধ থাকায়, সিরাজের মাত৷ এই মহাবিপ্লবের কিছুই অবগত ছিলেন না। তিনি চারিদিকে গোলযোেগ শুনিয়া, কারণানুসন্ধানে সমস্ত জানিতে পারিলেন। তখন তিনি আত্মবিস্মৃত হইয়া অবগুণ্ঠন উন্মোচনপূর্বক দ্রুতপদে রাজপথে উপস্থিত হইলেন। যাহার ভাগ্যে, সকল সময় সূর্যের আলোক দেখা ঘটিয়া উঠিত না, পুত্রের তাদৃশ শোচনীয় পরিণামশ্রবণে, তিনি আজ রাজপথে উপস্থিত। অনন্তর তিনি হস্তিপৃষ্ঠ হইতে তনয়ের মৃতদেহ নামাইয়া, পুনঃ পুনঃ চুম্বনপূর্বক, তাহা বক্ষস্থলে ধারণপূর্বক ছিন্নমূল ব্রততীর ন্যয় ভূতলে পতিত হইলেন এবং অনবরত নিজ বক্ষে ও মুখে করাঘাত করিতে লাগিলেন।[১] এই দৃশ্যে নগরবাসী সকলের হৃদয় বিগলিত ও অশ্রুধারায় প্লাবিত হইল। নবাব আলিবর্দীর কন্যা ও সিরাজ-জননীর রাজপথে এইরূপ শোচনীয় অবস্থা দেখিয়া খাদেম হোসেন খাঁ নামক জনৈক সম্ভ্রান্ত মুসলমান অনুচরসহ তথায় উপস্থিত হইয়া তাহাকে ও অন্যান্য স্ত্রীলোকদিগকে বলপূর্বক অন্তঃপুরমধ্যে লইয়া যান। অনন্তর সিরাজের মৃতদেহ নদীর পরপারে খোশ্‌বাগে প্রেরিত ও আলিবর্দীর পার্শ্বে সমাহিত করা হইল। সিরাজের শোচনীয় পরিণাম মনে করিতে গেলে, বাস্তবিক হৃদয় কারুণ্যরসে আপ্লুত হইয়া পড়ে। ইহার উপর আবার তাহাকে ঐতিহাসিকগণের চিত্রে কালিমামণ্ডিত হইতে হইয়াছে! খোশ্‌বাগের সমাধিগৃহে আলিবর্দীর পার্শ্বে এক্ষণে সিরাজ চিরবিশ্রাম লাভ করিতেছেন। মুতাক্ষরীনকার বলেন যে, সিরাজের হত্যসম্বন্ধে মীরজাফর কিছুই জানিতেন না; কিন্তু রিয়াজুস সালাতীনকার উল্লেখ করিয়াছেন যে, জগৎশেঠ ও ইংরেজসর্দার সিরাজের হত্যাকাণ্ডের জন্য মীরজাফরকে পরামর্শ দিয়াছিলেন।[২] কোন্ বিবরণ সত্য, তাহা আমরা সাহস করিয়া বলিতে পারি না।

 সিরাজের পূর্ব পার্শ্বে তাহার ভ্রাতা মির্জা মেহেদী[৩] শায়িত রহিয়াছেন। মির্জা মেহেদী পঞ্চদশ বৎসর বয়সে মীরজাফরের আদেশে জীবন বিসর্জন দিতে বাধ্য হন।

  1. Mutaqherin, Vol, I, p. 779.
  2. Riyaz-us-salatin, p. 373
  3. মির্জা মেহেদীকে রিয়াজে মির্জা মহম্মদ আলি নামে উল্লেখ করা হইয়াছে।